কোরআন সংকলনকারক ও বিশারদদের মধ্যকার ভয়ংকর বিবাদঃ
বুখারী শরীফের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) এর কাছে অনুমতি চান যেন কোরআন সংগ্রহ করার। উত্তরে আবু বকর তাকে বললেন—কিভাবে তুমি এ কাজটি করতে পার যা আল্লাহর নবী নিজেই করেন নাই কিংবা আমাদের করতেও বলেন নাই? পরবর্ত্তীতে, ইয়ামামা যুদ্ধের পর আবু বকর ওসমানের এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং যায়দ ইবনে তাহবিদকে এ কাজের দায়িত্ব প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে যায়দ বলেন, আল্লাহর কসম যদি আমাকে আদেশ করা হতো পর্বতকে তুলে অন্যত্র সরিয়ে দেবার, সে কাজটিও আমার জন্য সহজতর হতো এই দায়িত্বের চেয়ে।
আমরা জানিনা কেন নবীজি এই কাজটি (কোরআন সংগ্রহের) করার দায়িত্ব কাউকে দিয়ে যান নাই। কেনই বা জিবরাইল ফেরেশতা তাকে এই কাজটি করে যেতে বলেন নাই যাতে বিবাদ এড়ানো যেতো?
তিনি যদি তা করতেন তাহলে ওই অধ্যায়গুলো নিয়ে বিবাদ এড়ানো সম্ভব হতো। পক্ষান্তরে, ওমর কাজটি করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন কারণ ইয়ামামা যুদ্ধে অনেক কোরআনে হাফেজ মারা গিয়েছেন যারা ছিলেন কোরআনে হাফেজ ও অভিজ্ঞ। সে কারণেই হয়তো যায়দ বলেছেন— “এর চেয়ে পাহাড় সরানো সম্ভব কাজ।” তার ভয় ছিল কিভাবে তিনি কোরআনের সমগ্র তথ্য সংগ্রহ করবেন?
ডঃ আহমেদ সালাবী তার The History if Islamic Law বইয়ের ৩৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন— কোরআন যায়দের নেতৃত্বে সংগৃহীত করা হয়েছিল এবং তা ওমরের পরবর্ত্তীকালে ওমর কন্যা হাফসার কাছে জমাকৃত ছিল। ওসমান তার সংগৃহীত কোরআন সংকলনের পর তা চেয়ে নেন এবং পুড়িয়ে ফেলেন। প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, তাহলে কি ওসমানের সংগ্রহের সাথে এর অমিল ছিল? তড়িঘরি করে কোরআনের অন্যান্য আয়াত পুড়িয়ে ফেলে তিনি কি নাফরমানির কাজ করেন নাই? আল্লাহ্ পাক করবেন সে বিচার।
তবে ইসলাম বিশারদ ইবরাহীম আল-আবইয়ারী তার “The History of the Quran” বইতে (৩য় সংকলন, ১৯৮২ পৃষ্ঠা ১০৭ দ্রষ্টব্য) তে বলেছেন—কোরআনের আরো অন্যান্য কপি রয়েছে যেমনঃ আবি মূসা আল-আসআরী, আল মাকদাদ ইবন আল আসওয়াদ এবং সেলিম এর কপিগুলো। সেসব কপিগুলোতে ভিন্নতা ছিল কিন্তু ওসমান এক আদেশ জারি করে তা করায়ত্ব করেন, কারণ কুফাবাসী ইবন মাসুদের কপি সমূহ অনুসরণ করতো। মিশরীয়রা অনুসরণ করতো আবিকার এর কপিসমূহ। বসরাবাসী অনুসরণ করতো মূসা-আল-আসতারীর সংগৃহীত কপি। দামাস্কাসবাসী অনুসরণ করতো ইবন মাকদাদ এর কপিসমূহ। তার এই বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠায় ইবরাহিম আল- আবইয়ারী আরো বলেন— কোরআনের নূকতা ব্যবহার ও বাচনভঙ্গি ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উচ্চারণে কোরআন তেলাওয়াত হতো। তার এই বইয়ের ৪১ পৃষ্ঠায় ইবরাহিম আল-আবইয়ারী ইবন কুতায়রা-র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, এইসব বিভিন্ন উচ্চরণের অর্থও ছিল ভিন্নতর। তার এই ১০৯ পৃষ্ঠায় তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, যখন আবু বকর ও ওমর কোরআন সংগ্রহের দায়িত্ব যায়দ ইবন তাহবিদকে দিয়েছিলেন তখন সে সময়ের পূর্বে সংগৃহীত ছিল যা, তা করা হয়েছিলো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা যেমন- আলী ইবন আবু তালিব, ইবন মাসুদ এবং ইবন আব্বাস ও অন্যান্যরা।
এখন প্রশ্ন হতে পারে কেন তবে হযরত আবু বকর কষ্ট করে কোরআন সংগ্রহের কাজ শুরু করলেন যখন ইবন মাসুদ ও ইবন আব্বাসের মতো গুণীজন ইতিমধ্যে তা সংগ্রহ করেছেন? কেন তারা অন্ততপক্ষে এইসব ইসলাম বিশারদদের সঙ্গে কিন্ঞ্চিৎ আলোচনাও করলেন না বিষয়টি হাতে তুলে নেবার পূর্বে?
আলীর সংগৃহীত কোরআনের কপির ব্যাপারেও ইমাম খুই তার বই ‘আল বয়ান’ (পৃষ্ঠা ২২২) তে বলেছেন— আলীর কপিকৃত কোরআনটি ছিল একটা প্রশ্নাতীত ব্যাপার। কোরআন বিশারাদ সমস্ত মণীষীরা স্বীকার করেন এবং বলেন যে, এতে অতিরিক্ত আয়াতগুলি রয়েছে যা বর্তমান কোরআনে নেই। এই অতিরিক্ত আয়াতসমূহ ‘আল্লাহ-র প্রত্যাদেশ’ অধ্যায়ে সন্নিবেষিত রয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমাম খুলি হলেন শিয়া সম্প্রদায়ের অন্যতম একজন ধর্ম বিশেষজ্ঞ। তিনি তার তথ্য সংগ্রহ করেছেন ইমাম তাবাবীর নথিকৃত তার বই ‘আল-ইমতিয়াজ’ থেকে (ডঃ মূসার The Shites and the reformation, page 132, 133 দ্রষ্টব্য)। ডঃ মূসা একথাও বলেছেন যে, আমাদের ইসলাম বিশারদরা তাবাবীর আল-ইমতিয়াজ পুস্তকের নথিকৃত হযরত আলীর কোরআনের কপি-র বিষয়ে আজও অজ্ঞ আছেন। এক সময় আলী তালহা (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) এর আত্নীয় কে বলেছিলেন যে, আল্লাহর প্রত্যেকটি আয়াত যা তিনি নবীজির উপর নাজিল করেছেন তা আমার সংগ্রহে আছে। কারণ তিনি নিজেই আমাকে সেসব লিখে রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন।
ডঃ মূসা একথাও বলেছেন যে, ইমাম আল খুই এর তত্ত্বাবধানে তিনি একসময়ে ভয়ংকর বির্তকে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এমনকি শেখ কিশ (Sheikh Kishk) যিনি ছিলেন সুন্নী মতাবলম্বীদের একজন ধর্ম বিশারদ, একই কথা বলেছেন তার বইয়ে (Legal Opinion, Part 1, Page 103 দ্রষ্টব্য)।
হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন, আমাকে আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন। আল্লাহর কসম এমন কোন আয়াত নেই যা আমি জানিনা। তা সে রাতের বেলা হোক কিংবা দিনের বেলা। তা সে সমতল ভূমিতে নাজিল হোক কিংবা পাহাড়ে তা আমার জানা আছে। ইবন মাসুদের সম্পর্কে তিনি দুঃখ করে বলেছেন— ইবন মাসুদ, ইবন আবিক’ব ও ইবন আব্বাস তারা সবাই উপেক্ষিত হয়েছেন কোরআন সংরক্ষণে তাদের অবদান নিয়ে। অথচ তারাই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও তাদের কোরআন সংগ্রহ ছিল অত্যান্ত সঠিক। আলীর সংগ্রহে অতিরিক্ত আরো আয়াত সংযোজন থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষিত হয় ওসমানের কাছে। আর এভাবেই ওসমান তার কোরআন তুলে দেন আজকের ইসলাম অনুসারীদের হাতে। আর তার ভ্রান্ত পরিচালনায় আজকে ইসলামী বিশ্বে শান্তির পরিবর্তে শাস্তি কায়েম করার প্রবৃত্তি চালু হয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এরই জের ধরে মুহাম্মদ ইবন আবু বকর (হযরত আবু বকরের পুত্র ও আয়েশার ভাই) আম্মার ইবন ইয়াসির এর সাথে ওসমানকে কতল করেছিলেন এই বলে যে, “তুমি আল্লাহর কিতাব পরিবর্তন করেছো” (The Pielaya and the Nihaya, Part 7, Page 185 দ্রষ্টব্য)।
আরও জানুন: কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (১ম খণ্ড) |
Pingback: কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৮ম খণ্ড) | all about Him