You are currently viewing কোরআনে জের জবার পেশ ইত্যাদির ব্যবহারের ইতিহাস

কোরআনে জের জবার পেশ ইত্যাদির ব্যবহারের ইতিহাস

  • Post author:
  • Post last modified:October 21, 2021

রকত ও নুখ্‌তা-র ব্যবহার: কোরআন যখন অবতীর্ণ হয় তখন এতে কোন জের, জবার, পেশ্‌ ইত্যাদির ব্যবহার ছিলনা। অর্থাৎ বুঝে নিতে হবে যে- জের, জবার, পেশ্‌ আল্লাহর কাছ থেকে নাজিল হয় নাই। এর উৎপত্তি হয় বনু উমাইয়া যুগে ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সময়কালে, ৮৬ হিজরিতে (৬৬০-৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে)। জের, জবার, পেশ্‌ তারই সৃষ্টি। হযরত ওসমানের কোরআনে এর কোন স্থান ছিলনা। এর সংযোজনের কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, যাদের মাতৃভাষা আরবি নয় তাদের আরবি ভাষা তথা কোরআন শরীফ পড়তে অসুবিধা হওয়ায় এই পদ্ধতি চালু করা হয়। আরবরা কোন হরকত ছাড়াই আরবি ভাষায় যে কোন বই বা কিতাব পড়তে পারে। কিন্তু অনারব ব্যক্তির পক্ষে তা কষ্টকর। কাজেই ইসলামের সম্প্রসারণের প্রয়োজনে এর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে পড়ে (আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ রচিত মহা-গ্রন্থ আল-কোরআন কি ও কেন, পৃষ্ঠা ৭০-৭১, খেলাফত পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত)।

তার মানে কি এই নয় যে, ঐশ্বরিক গ্রন্থে এই জাগতিক সংযোজন হয়েছে কোরআন আবির্ভাবের অনেক অনেক পরে? এ ব্যাপারে আল্লাহর বান্দারা আল্লাহ্‌ তায়ালাকে সাহায্য করেছেন প্রচুরভাবে।

কে এই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ:

এখানে তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সংযোজন করছি। এবার দেখা যাক, এই হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে ছিলেন এবং তার কোন্‌ কর্মপ্রয়াসে তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছেন।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন উমাইয়া বংশের একজন নিষ্ঠুর শাসনকর্তা যিনি আরবি শিক্ষকতা থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ক্ষমতা দখল করে শাসকের বেশে আবির্ভূত হন।

তার রাজনৈতিক নিপুণতা ও নিষ্ঠুরতার কারণে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন সর্বাধিক। ইসলামের ইতিহাসে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের অত্যাচার চরম নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্তে পরিণত হয়ে আছে।

মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াযীদের মৃত্যুর পর বনী উমাইয়া খেলাফত যখন টলটলায়মান হয়ে পড়লো ঠিক তখনই হাজ্জাজ তার ক্ষমাহীন তরবারির আঘাতে অবিরাম রক্ত বন্যায় সেই ধ্বংস প্রায় ইমারতের বুনিয়াদ আবার দৃঢ় ভিত্তির উপর পূণঃ প্রতিষ্ঠিত করেন।

তার সময়কালে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের ছিলেন বনী উমাইয়া বংশের সর্বাধিক ভয়ের কারণ। যোবায়ের এর শাসন কেন্দ্র ছিল মক্কা। কিন্তু সিরিয়া পর্যন্ত ছিল এর বিস্তার। অথচ তাকে করায়ত্ত করে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। প্রথমে তিনি মক্কা অবরোধ করলেন। কা’বার গায়ে “মনজানিক” যোগে প্রস্তর নিক্ষেপ করলেন এবং অবশেষে ইবনে যোবায়েরকে নির্মমভাবে হত্যা করলেন। এভাবেই তিনি নিজেকে ইসলামী শাসনকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন।

ইরাকে শাসনকার্য পরিচালনা করা সবসময়েই ছিল দুষ্কর। কারণ ইরাক ছিল সবসময়েই ষড়যন্ত্রকারীদের কেন্দ্রস্থল। সেখানে রাজনৈতিক চাঞ্চল্য সবসময়েই লেগে থাকতো। কোন শাসনকর্তাই সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন নাই। কিন্তু হাজ্জাজের তরবারির বেপরোয়া আঘাতে ইরাকের সব ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটিত হয়েছিল। তার সমসাময়িক লোকেরা তার এই সাফল্য দেখে আশ্চর্য হয়েছেন। কাসেম ইবনে সালাম একসময়ে বলেন– “কূফার লোকদের স্বাধীন চিত্ততা ও আত্মগরিমা এখন কোথায় গেল?” তারা আমীরুল মো’মেনীন হযরত আলী (রা:)কে হত্যা করেছে, হযরত হোসায়েন (রা:) ইবনে আলীর মস্তক দ্বি-খণ্ডিত করেছে।

মোখতাবের ন্যায় পরাক্রমশালী পুরুষকে বিনাশ করেছে। কিন্তু এই কুদর্শন মালাউনের (হাজ্জাজ) এর সামনে সবাই লাঞ্ছিত হলো একে একে। কুফায় একলক্ষ আরব থাকা সত্ত্বেও এই পাপিষ্ঠ মাত্র বারোজন অশ্বারোহীসহ আসিয়া সমগ্র দেশকে গোলামে পরিণত করিয়া ফেলিয়াছে।

এই সেই হাজ্জাজ যিনি কোরআনে যের, জবর, পেশ্‌ সংযোজন করে কোরআনকে ধন্য করেছেন, সেইসাথে আমাদেরও। সমস্যাটি সেখানে নয়। সমস্যাটি হলো মুহাম্মদ (সা:) এর কোরআনকে কয়জন কয়-ভাগে ভাগ করেছেন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন অবশেষে অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাতে এক বদমাশ এর দেওয়া রূপকে কার্যকর করেছেন মানবিক ভাষার ব্যাকরণে। আর অবশেষে তাকেই বলেছেন আল্লাহর আরশ থেকে আসা আল্লাহর কালাম।

এতকিছুর পরেও অনেকে মুখ বন্ধ করে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। প্রধানত: দুইটি কারণ রয়েছে এর পিছনে। প্রথমটি হলো- এ নিয়ে উচ্চবাক্য করলে বদনাম হবে ইসলামের, সেইসাথে অরাজকতা ও বিভ্রান্তি ছড়াতে দেরী হবেনা। দ্বিতীয়টি হলো- এভাবে চলছে চলুক না, মনোভাব। কারণ, উমাইয়া বংশের ৭২ বছরের শাসনে কারো প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ছিলনা। তাই মুখ বন্ধ করে তাদের তা হজম করতে হয়েছে। আজকে তা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা হবে “তাদের অস্তিত্ব খর্ব করার সামিল।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে যত গালাগালিই করা হোক না কেন তার ইসলামী ট্যাবলেট না খেয়ে উপায় নেই কারো। এভাবেই চলছে, চলবেও আজীবন।

হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কোরআনের জের, জবার, পেশ ছাড়াও এর বেশ কিছু অংশ পরিবর্তন করেছেন যা অনেকেরই জানা নাই, এমনকি আলেম ওলামায়েদেরও অজানা। কয়েকটি নমুনা নীচে দেওয়া হলো।

১। সূরা ইউনুস এর (১০:২২) আয়াতটি হাজ্জাজ পরিবর্তন করে করেছেন “ইউসায়্যিরুকুম” অর্থাৎ (তোমাদের ভ্রমণ করান)। “যা ছিল ইয়ানসরোকম” অর্থাৎ (তোমাকে ছড়ান)।

২। সূরা আশশুয়ারা (২৬: ১১৬) আয়াতটি যা ছিল “আল মুথরাজিন” অর্থাৎ (বিতাড়িত করা) তা পরিবর্তন করে করেছেন “আল মারজুমীন” যাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করা হবে।

৩। সূরা আশশুয়ারা (২৬: ১৬৭) আয়াতে যা ছিল “মীন আল-মারজুমীন” অর্থাৎ (যাদেরকে প্রস্তর মেরে হত্যা করা হবে) তিনি পরিবর্তন করে করেছেন “আল মুখরাজীন” অর্থাৎ যাদেরকে অবশ্যই বিতাড়িত করা হবে)।

৪। সূরা মুহাম্মদ (৪৭: ১৫) আয়াতটি তিনি পরিবর্তন করেছেন যা ছিল “ইয়াসিন” নিম্নমানের আরবিয় “আসেন” থেকে, যার অর্থ unpolluted.

৫। সূরা আল-হাদীদ (৫৭: ৭) আয়াতটি তিনি পরিবর্তন করেছেন যা ছিল “ওয়াতাকু” যার অর্থ আল্লাহকে ভয় কর। তা থেকে পরিবর্তন করে করেছেন “ওয়াআনফাকু” অর্থাৎ spent in charity দান করো।

যদি কেউ কোরআনের তাফসীর (আল-জালালাইন বা অন্য কারো) পড়ে তাহলে নিশ্চয় লক্ষ্য করতে পারবে যে তাদের বর্ণনায় আরও অন্যরকম অর্থ আছে যা প্রমাণ করে কোরআনের বিকৃত (corruption) চিত্র। সমরখন্দ কডেস্ক এবং ওসমানের কডেস্ক পড়ে দেখুন।

যুদ্ধের সময় ছাড়াও শুধু শান্তিকালীন অবস্থায় হাজ্জাজ একলক্ষ পঁচিশ হাজার মুসলমানকে হত্যা করে ইরাকে নিজের শাসন ক্ষমতা বহাল রাখেন। (আকদুল ফরীদ, আলবয়ান। মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রচিত, পৃষ্ঠা ১৩০)।

সাঈদ ইবনে জোবায়ের এর মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সৎ লোকদেরও তিনি মস্তক উড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি মদিনার অসংখ্য সাহাবীর হাতে সীসার মোহর এঁটে দিয়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে ওমরের ন্যায় বিশিষ্ট সাহাবীকেও তিনি হত্যা করেছিলেন। বর্তমান যুগের সাম্রাজ্যবাদী নীতির ন্যায় হাজ্জাজের আমলেও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার খাতিরে সবকিছু বৈধ মনে করা হতো। তার নীতি ছিল যে, কঠোর শাসন ও তীব্র দমন নীতি দিয়ে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সুবিচার ও অনুকম্পা দিয়ে নয়।

সে যুগের ধর্মপরায়ণ ব্যক্তিরা হাজ্জাজকে খোদার গজব এবং শাস্তি বলে মনে করতেন। হযরত বসরী বলেন, চেয়ো না, বরং আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে অপসারণের চেষ্টা করো।

এ কারণেই হাজ্জাজের মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্র হযরত হাসান বসরী (রা:) এবং ওমর ইবনে আব্দুল আযীয আল্লাহর দরবারে সেজদায় পতিত হয়েছিলেন এবং তাদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল- “এ যুগের ফেরআউনের মৃত্যু হয়েছে।”

এমন এক জঘন্য ব্যক্তির সুনিপুন হাতের কর্ম-প্রয়াস হলো কোরআনের জবার, জের, পেশ এর সংযোজন। বলা হয়ে থাকে আনারবিয়দের কাছে কোরআন শরীফ পড়া সহজতর করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এ কাজটি করেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ একথাও বলেন যে, এটা উমাইয়া বংশের একটি সুচতুর কৌশল শুধুমাত্র নিজেদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার কারণে। (মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ স্বীকার করেছেন এই সত্যতা, পৃষ্ঠা ১৩০ দ্রষ্টব্য)।

সারাংশ

আমরা সবাই কি জানি এ তথ্য? হয়তো কেউ কেউ জানি কিন্তু মুখ খুলি না। কিন্তু আমরা যদি এ কথা জেনেও বলি যে, কোরআন আল্লাহর আরশ থেকে আসা, তারই পবিত্র কিতাব তখন কি তা মিথ্যাচার হয় না? হয় বৈকি! তবে কি আমাদের মেনে নিতে হবে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আল্লাহর কালামকে এই সুন্দর রূপ দিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই ধরাধামে?

এই যদি হয়ে থাকে কোরআন আবির্ভাবের নমুনা তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে তা এসেছে আল্লাহর আরশ থেকে নবীজির হাতে? এ প্রসঙ্গে উত্তরটি আপনাদের ব্যক্তিগত বিবেচনায় ছেড়ে দিতে চাই। আপনার নিজস্ব চিন্তা আর বিশ্লেষণে আপনি নিজেই উদ্ভাবন করতে পারবেন সত্যের অকৃত্রিম পথ। দয়া করে একটু ভেবে দেখুন কে দিয়েছে হাজ্জাজকে এই পরিবর্তনের অধিকার?

আরও পড়ুন: তার অবিচারের বলি যখন এক নিরপরাধ ব্যক্তি

 

Leave a Reply