You are currently viewing কোরবানী প্রসঙ্গ ও আমাদের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

কোরবানী প্রসঙ্গ ও আমাদের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

  • Post author:
  • Post last modified:August 11, 2021

সারা বিশ্বের মানুষ ঈদ-উল-আযহা উদযাপন করেন হজ্বের পর পরই। কোরবানী প্রসঙ্গে বলা হয়ে থাকে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর একমাত্র পুত্র হযরত ইসমাইলকে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর আদেশে কোরবানী করতে উদ্যত হন। তাঁর এ বাধ্যতা দেখে আল্লাহ্ স্বয়ং তাকে সন্তানের স্থলে এক হৃষ্টপুষ্ট দুম্বা দান করলেন, যাকে ইসমাইলের পরিবর্তে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কোরবানী করেছেন। অথচ এটা একটি বিশাল মিথ্যার প্রচলন।

সত্যের অপব্যাখ্যা মিথ্যার সামিল। কোরআন শরীফের সূরা সাফ্ফাত, ৩৭:১০০-১১৩ আয়াতে যেখানে কোরবানীর কথা বলা হয়েছে, সেখানে ইসমাইলের কোন নাম গন্ধও নাই। তবে কোথা থেকে সংযোজিত হল তার নাম? আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয় যে, হযরত ইসমাইল (আঃ) কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সত্যিকারের পুত্রও নন। তিনি তাঁর বাঁদীর ছেলে, যদিও তাঁরই ওরসে তাঁর জন্ম। তাঁর সত্যিকারের পুত্র হলেন হযরত ইসহাক (আঃ)। অত্যন্ত বৃদ্ধাবস্থায় ইব্রাহিমের ওরসে ও বিবি সারার গর্ভে জন্ম হয় ইসহাকের। তার জন্মের মধ্য দিয়েই সারার জীবনের বন্ধ্যাত্ব ঘুঁচে যায়। আর এর মধ্য দিয়েই ইব্রাহিমকে দেওয়া আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তব রূপ লাভ করে।

ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী সারার সন্তান ধারণের ক্ষমতা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে অত্যন্ত বৃদ্ধাবস্থায় তিনি যখন অনুধাবন করেছিলেন তাঁর আর সন্তান হবার সম্ভাবনা নাই, তখন তিনি ইব্রাহিম (আঃ)-কে অনুমতি দিয়েছিলেন তার বাঁদী হাজেরাকে গ্রহণ করতে। আশা ছিল তার মধ্য দিয়ে ইব্রাহিমের সন্তান উৎপন্ন হলে আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুতি পরিপূর্ণতা পাবে। কিন্তু আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ্ তায়ালা সর্বদাই তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে সক্ষম।

এ প্রসঙ্গে তাওরাত শরীফের উদ্ধৃতি লক্ষ্যণীয়। এখানে বলা হয়েছে আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে আরও বললেন, “‘তোমার স্ত্রী সারীকে আর সারী বলে ডাকবে না, তার নাম হবে সারা। আমি তাঁকে রহমত দান করে তারই মধ্য দিয়ে তোমাকে একটা পুত্র সন্তান দেব। আমি তাকে আরও রহমত দান করব যাতে সে অনেক জাতির এবং তাদের বাদশাহদের আদি মাতা হয়।’ এই কথা শুনে ইব্রাহিম মাটিতে উবুড় হয়ে পড়লেন এবং হেসে মনে মনে বললেন, তাহলে সত্যিই একশো বছরের বুড়োর সন্তান হবে, আর তা হবে নব্বই বছরের স্ত্রীর গর্ভে’” (তাওরাত শরীফ, পয়দায়েশ ১৭:১৫-১৭ আয়াত)।

ইসহাকের জন্মের পর হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ইসমাইলকে তার মা সহ মিসরে পাঠিয়ে দেন, কারণ বিবি সারার সাথে হাজেরার মত-পার্থক্য দেখা দিয়েছিল এবং দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

(কোরআন শরীফের সূরা সাফ্ফাত (৩৭)১০১-১১৩ আয়াত এবং তাওরাত শরীফের পয়দায়েশ ১৭:১৫; ২৫:১২; ২২:১-১৩ দ্রষ্টব্য)।

হাজেরার অহংকার আর ঔদ্ধত্যে বিবি সারা হযরত ইব্রাহিমকে বারে বারে অনুরোধ করতে থাকেন তাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। উপায় না দেখে ইব্রাহিম (আঃ) তখন আল্লাহর শরণাপন্ন হন ও তাঁর ইচ্ছা জানতে চান।

অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছানুক্রমে তিনি হাজেরাকে তাঁর পুত্র ইসমাইল সহ মিসরে পাঠিয়ে দেন। বস্তুতঃ হাজেরা ছিলেন মিসরীয় বংশোদ্ভূত মহিলা। এদিকে ইসহাক ক্রমশঃ তাদের চোখের সামনে বেড়ে উঠতে থাকল।

কোরআন শরীফের সূরা সাফ্ফাত-এর ৩৭:১০১-১১৩ আয়াতে পাওয়া যায় এর বিস্তারিত বিবরণ এইভাবে-

فَبَشَّرْنَـٰهُ بِغُلَـٰمٍ حَلِيمٍ (١٠١) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعْىَ قَالَ يَـٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرَىٰ فِى ٱلْمَنَامِ أَنِّىٓ أَذْبَحُكَ فَٱنظُرْ مَاذَا تَرَىٰ ۚ قَالَ يَـٰٓأَبَتِ ٱفْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰبِرِينَ (١٠٢) فَلَمَّآ أَسْلَمَا وَتَلَّهُۥ لِلْجَبِينِ (١٠٣) وَنَـٰدَيْنَـٰهُ أَن يَـٰٓإِبْرَٰهِيمُ (١٠٤) قَدْ صَدَّقْتَ ٱلرُّءْيَآ ۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُحْسِنِينَ (١٠٥) إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلْبَلَـٰٓؤُا۟ ٱلْمُبِينُ (١٠٦) وَفَدَيْنَـٰهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ (١٠٧) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى ٱلْـَٔاخِرِينَ (١٠٨) سَلَـٰمٌ عَلَىٰٓ إِبْرَٰهِيمَ (١٠٩) كَذَٰلِكَ نَجْزِى ٱلْمُحْسِنِينَ (١١٠) إِنَّهُۥ مِنْ عِبَادِنَا ٱلْمُؤْمِنِينَ (١١١) وَبَشَّرْنَـٰهُ بِإِسْحَـٰقَ نَبِيًّا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ (١١٢) وَبَـٰرَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَىٰٓ إِسْحَـٰقَ ۚ وَمِن ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِّنَفْسِهِۦ مُبِينٌ (١١٣)

বাংলা অর্থঃ “অতঃপর আমি তাঁকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অত:পর পিতার সঙ্গে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হলে একদিন পিতা তাঁকে বলল, বৎস! স্বপ্নে আমি দেখি তোমাকে জবাই করছি, এখন তোমার অভিমত কি? সে বলল, হে পিতা! যা আদিষ্ট হইয়াছে তাই করুন। ইনশাআল্লাহ্ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। তখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য করলো এবং সে তাঁর পুত্রকে কাত করে শোয়াইল। তখন তাকে আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মীদের পুরস্কৃত করি। নিশ্চয় এ ছিল এক  স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি এতদস্থলে কোরবানীর জন্য এক হৃষ্টপুষ্ট জন্তু দিলাম।

আমি এ পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইব্রাহিমের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি সৎকর্মীদের পুরস্কৃত করি। সে ছিল আমার এক বিশ্বাসী দাস; তাকে আমি ইসহাকের সুসংবাদ দিয়েছিলাম, সে ছিল একজন নবী, সৎকর্মীদের অন্যতম, তাকে এবং ইসহাককে আমি সমৃদ্ধি দান করেছিলাম; তাদের বংশদরদের মধ্যে ছিল কিছু সৎকর্মপরায়ণ এবং কিছু নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী ছিল।”

এই সূরার তাফসীরকারকেরা প্রত্যেকেই বলেছেন এখানে ইসহাকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ কোন্ দুঃখে আজকে তা ইসমাইলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল? কোরআনের তথ্যানুযায়ী এখানে ইসমাইলের কোন অবস্থান নেই। কিন্তু সারা বিশ্বের মানুষ কোরবানীর এই বিশেষ ঘটনাটিতে ইসমাইলকে কোরবানী করা হয়েছে বলে জানেন। এ বিষয়ে একটি চাতুরীপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে সত্যকে আড়াল করার কৌশলকে বেছে নিয়েছেন বিজ্ঞ-ধর্মবিশারদরা। তারা বলেন, প্রথম পুত্র আরবীয় সমাজে অত্যন্ত মর্যাদাশীল। যেহেতু ইসমাইল হযরত ইব্রাহিমের প্রথম পুত্র সেহেতু তাঁকে এই মর্যাদা দেওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এ কথা বুঝতে হবে যে, আমাদের দৃষ্টিতে যা বাঞ্ছনীয়, আল্লাহর দৃষ্টিতে তা নাও হতে পারে। আমাদের অবশ্যই নিজেদের মতবাদ নয়, বরং আল্লাহর কালামকে অনুসরণ করা প্রয়োজন।

কিভাবে আমরা কোরআনের এই অংশটিতে নিজেদের মতামত স্থাপনের মধ্য দিয়ে অল্লাহর কালামকে অবজ্ঞা করে চলেছি? বিজ্ঞবান ধর্মশিক্ষকেরা হয়তো ভেবেছেন তাদের বুদ্ধি-বিবেচনা আল্লাহর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী, তাই তারা আল্লাহর ভুলটি শুধরে দিচ্ছেন!

ইব্রাহিম (আঃ) ইসমাইলকে নয় ইসহাককে কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তাওরাত শরীফেও তার প্রমাণ মিলে। সেখানে এভাবে তা বর্ণনা করা হয়েছে “এই সমস্ত ঘটনার পর ইব্রাহিমকে আল্লাহ্ এক পরীক্ষায় ফেললেন।

আল্লাহ তাঁকে ডাকলেন, ইব্রাহিম’। ইব্রাহিম জবাব দিলেন, এই যে আমি।’ আল্লাহ্ বললেন, তোমার ছেলেকে’ অদ্বিতীয় ছেলে ইসহাককে যাকে তুমি এত ভালবাস তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া এলাকায় যাও। সেখানে যে পাহাড়টার কথা আমি তোমাকে বলব তার উপরে তুমি পোড়ানো- কোরবাানী হিসেবে কোরবানী দাও।’ সেই জন্য ইব্রাহিম ফজরে উঠে একটা গাধার পিঠে গদি চাপালেন।

তারপর তাঁর ছেলে ইসহাক ও দু’জন গোলামকে সঙ্গে নিলেন, আর পোড়ানো কোরবানীর জন্য কাঠ কেটে নিয়ে যে জায়গার কথা আল্লাহ্ তাঁকে বলেছিলেন সেই দিকে রওয়ানা হলেন। তিন দিনের দিন ইব্রাহিম চোখ তুলে চাইতেই দূর থেকে সেই জায়গাটা দেখতে পেলেন। তখন তিনি তাঁর গোলামদের বললেন, ‘তোমরা গাধাটা নিয়ে এখানেই থাক; আমার ছেলে আর আমি ওখানে যাব। ওখানে আমাদের এবাদত শেষ করে আবার আমরা তোমাদের কাছে ফিরে আসব।’ এই বলে ইব্রাহিম পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠের বোঝাটা তাঁর ছেলে ইসহাকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আগুনের পাত্র ও ছোরা নিলেন। তারপর তাঁরা দু’জনে একসঙ্গে হাঁটতে লাগলেন। তখন ইসহাক তাঁর পিতা ইব্রাহিম কে ডাকলেন, ‘বাবা।’

ইব্রাহিম বললেন, ‘জ্বি আব্বু, কি বলছ?’

ইসহাক বললেন, ‘পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠ আর আগুন রয়েছে দেখছি, কিন্তু ভেড়ার বাচ্চা কোথায়?’

ইব্রাহিম বললেন, ‘আব্বু পোড়ানো কোরবানীর জন্য আল্লাহ্ নিজেই ভেড়ার বাচ্চা যুগিয়ে দেবেন।’ এইসব কথা বলতে বলতে তাঁরা এগিয়ে গেলেন। যে জায়গার কথা আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে বলে দিয়েছিলেন তাঁরা সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে পৌঁছে ইব্রাহিম একটি কোরবানগাহ তৈরী করে তার উপর কাঠ সাজালেন। পরে ইসহাকের হাত-পা বেঁধে তাঁকে সে কোরবানগাহের কাঠের উপর রাখলেন। তারপর ইব্রাহিম ছেলেটিকে কোরবানী করবার জন্য ছোরা হাতে নিলেন। এমন সময় মাবুদের ফেরেশতা বেহেশত থেকে তাঁকে ডাকলেন,

‘ইব্রাহিম! ইব্রাহিম!’ ইব্রাহিম জবাব দিলেন, ‘এই যে আমি!’ ফেরেশতা তাঁকে বললেন,‘ছেলেটিকে মেরে ফেলবার জন্য হাত তুলো না বা তার প্রতি আর কিছুই কোরো না। তুমি যে আল্লাহ-ভক্ত তা এখন বোঝা গেল, কারণ আমার প্রতি তুমি তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলেকেও কোরবানী দিতে পিছপা হও নি।’

ইব্রাহিম তখন চারদিকে তাকালেন এবং দেখলেন তাঁর পিছনে একটা ভেড়া রয়েছে আর তার শিং ঝোপে আটকে আছে। তখন ইব্রাহিম গিয়ে ভেড়াটা নিলেন এবং ছেলের বদলে সেই ভেড়াটাই তিনি পোড়ানো কোরবানীর জন্য ব্যবহার করলেন” (তাওরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২২:১- ১৩ আয়াত)।

এটাই হল কোরবানীর প্রকৃত চিত্র। এই চিত্রটির প্রকৃত রূপ বিকৃত করে ইসমাইলের নাম সংযুক্ত করা হয়েছে। আর প্রকৃত সত্যটাকে আড়াল করা হয়েছে বিভিন্ন বিভ্রান্তির চাদরে।

এ প্রসঙ্গে সূরা আনকাবুত-এর ২৯:২৭ আয়াতটি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বলা হয়েছে-

وَوَهَبْنَا لَهُۥٓ إِسْحَـٰقَ وَيَعْقُوبَ وَجَعَلْنَا فِى ذُرِّيَّتِهِ ٱلنُّبُوَّةَ وَٱلْكِتَـٰبَ وَءَاتَيْنَـٰهُ أَجْرَهُۥ فِى ٱلدُّنْيَا ۖ وَإِنَّهُۥ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ لَمِنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ

বাংলা অর্থঃ “আমি ইব্রাহিমকে দান করিলাম ইসহাক ও ইয়াকুব এবং তাহার বংশধরদিগের জন্য স্থির করিলাম নবুওত (Prophethood) ও কিতাব (The Books) এবং আমি তাহাকে দুনিয়ায় পুরস্কৃত করিয়াছিলাম; আখিরাতেও সে নিশ্চয়ই সৎকর্মপরায়ণদিগের অন্যতম হইবে।”

কোরআনের এই আয়াতটি কি পরিষ্কারভাবে বলে না যে, ইসহাক ও ইয়াকুব (আঃ) এর বংশধরদিগের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা নবুওত ও কিতাব স্থির করে রেখেছেন? ইসমাইলের কথা তো এখানে উল্লেখিত হয় নাই।

শুধু তাই নয়, তিনি ইসহাকের তথা ইব্রাহিম (আঃ) এর বংশধর থেকে বারোটি গোষ্ঠী উৎপন্ন করেছেন এবং তারই মধ্য দিয়ে অন্যান্য নবীদের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীতে। ইব্রাহিম নিজে বিনতি প্রার্থনা করেছেন ইসমাইলের জন্য যেন তাকে আল্লাহ রহমতে পূর্ণ করেন। নিচের আয়াতগুলো তা প্রমাণ করে।

পরে ইব্রাহিম আল্লাহ্কে বললেন, “আহা, ইসমাইল যেন তোমার রহমতে বেঁচে থাকে!” তখন আল্লাহ্ বললেন, “তোমার স্ত্রী সারার সত্যই ছেলে হবে, আর তুমি তার নাম রাখবে ইসহাক (যার মানে হাসা)। তার ও তার বংশের লোকদের জন্য আমি আমার চিরকালের ব্যবস্থা চালু রাখব। তবে ইসমাইল সম্বন্ধে তুমি যা বললে তা আমি শুনলাম; শোন আমি তাকেও রহমত দান করব এবং অনেক সন্তান দিয়ে তার বংশের লোকদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে দেব, সেও বারোজন গোষ্ঠী-নেতার আদিপিতা হবে এবং তার মধ্য থেকে আমি একটা মহাজাতি গড়ে তুলব। কিন্তু ইসহাকের জন্যই আমি আমার ব্যবস্থা চালু রাখবো। সামনের বছরের এই সময়ে সে সারার কোলে আসবে” (তাওরাত শরীফ, পয়দায়েশ ১৭:১৮-২১ আয়াত)।

ব্যবস্থা (Covenant) হল আল্লাহর সাথে মানুষের নিয়মের বন্ধন। তিনি যুগে যুগে বিশেষ বিশেষ নবীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এইসব “ব্যবস্থার” একটি বিশেষ চিহ্ন রয়েছে। যেমন, নূহ (আঃ) এর সাথে আল্লাহর ব্যবস্থার চিহ্ন হল “রঙধনু”। এটা এমন এক স্মরণযোগ্য চিহ্ন যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আল্লাহর ব্যবস্থা, আল্লাহর রহমত আর প্রতিজ্ঞা। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে আল্লাহর ব্যবস্থার চিহ্ন হল খতনা করা। হযরত মূসা (আঃ) এর সময়েও তা বিদ্যমান ছিল।

আমরা দেখতে পাই, হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বিনীত অনুরোধে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ইসমাইলকেও তাঁর রহমত দানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন যে, তার মধ্য থেকেও তিনি বারোটি গোষ্ঠী উৎপন্ন করবেন। সেইমত হযরত ইসমাইলও ছিলেন বারোটি গোষ্ঠীর সর্দার ও নেতা। আরবীয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই ইসমাইলেরই বংশ থেকে আগত।

প্রশ্ন হল, কোরবানীর শিক্ষা অনুযায়ী যখন হযরত ইসমাইলের কথা বলা হয় তখন আমরা দেখি কোরআনে বলা হয়েছে হযরত ইসহাকের কথা। এটা কিভাবে সম্ভব? কোরআনকে উপেক্ষা করে তবে কি অন্য কিতাবের উপর আমাদের নির্ভরতা বেশী? এটাও কি মিথ্যার সামিল নয়?

কিতাবের বাজার আজ অনেক আজগুবি কিতাবে সয়লাব। যে যেভাবে পারেন নিজস্ব মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান উদ্ভব কল্পনার অভিনব শিক্ষায়, এতে ক্ষতিগ্রস্থ হন সাধারণ ধর্মভীরু মানুষ। আসমানী কিতাব আর তার বিভ্রান্তিতে ভোগেন অনেকে। তাই আমাদের উচিত স্থির চিত্তে, সত্য উদ্ঘাটনের অভিপ্রায়ে ধীরে ধীরে পড়ে যাওয়া আসমানী কিতাব সমূহ।

কেননা তা আমাদের কারণেই নাযিল হয়েছে। সুর করে শুধু সুমধুর উচ্চারণে ক্বেরাত পড়ার চেয়ে সূচারুরূপে ও স্পষ্টভাবে জানা দরকার কি আছে আল্লাহর কালামে। ঈদ-উল-আযহার সময় হযরত ইসহাক (আঃ) এর কথাটি সর্বদাই থেকে যায় গোপনে। আর বাঁদীপুত্র ইসমাইলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় সবাই। এটা কি সত্যের অপব্যাখ্যা নয়? কোন আয়াতের স্বপক্ষে কাজটি করে চলেছি আমরা?

আমার আজকের প্রার্থনা যেন মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন আপনার অন্তরচক্ষু উন্মোচন করে দেন আর দান করেন এক নতুন জ্ঞানের দিগন্ত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনার সত্য উদ্ঘাটনের আকাংখা আপনাকে নিয়ে যাবে এক বিস্তীর্ণ ইতিহাসের অনির্বচনীয় প্রাঙ্গণে।

প্রসঙ্গতঃ আমাদের বোঝা উচিৎ যে, আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের পশুত্বের কোরবানী চেয়েছেন পশুকে নয়। অর্থের বিনিময়ে পশুকে ক্রয় করা সম্ভব আর তা হত্যা করাও অতি সহজ কাজ। কিন্তু আমাদের ভেবে দেখা দরকার এই পশুর স্থলে যদি আমাদের সন্তান-সন্ততিকে কোরবানী করতে হতো তাহলে কি হতো? বস্ততঃ আমাদের পাপের পরিবর্তে পশু কোরবানীর মধ্য দিয়ে আমরা পাপ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি পেলেও এতে করে আমাদের সামগ্রীক পাপের বোঝার পরিপূর্ণ প্রায়চিত্ত হবে না কখনো। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের পশু কোরবানী প্রহসন উদযাপনে সন্তুষ্ট নন।

তিনি চান আমরা যেন আমাদের অন্তরের পশুত্ত্বকে কোরবানী করি তাঁর চরণে। আর সততায় পথ চলি তাঁর সত্য বাক্যের নির্দেশনায় । ইতিমধ্যে কতবড় আর বিশাল পেশীযুক্ত গরু কিনে আপনি প্রস্তুত হয়েছেন এবারের কোরবানীর জন্য তা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি আপনার প্রত্যাশা সমূহ ধূলায় লুন্ঠিত হবে যদি না আপনি নিজের পশুত্ত্বকে বিসর্জন দিয়ে তাঁর চরণে উপস্থিত হন। আপনার পশু কোরবানী নয় আপনার অন্তরের পরিবর্তন দেখতে চান তিনি। ধর্মীয় বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হয়ে আসুন তাঁর ভালবাসার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হই। আমিন।

This Post Has One Comment

Leave a Reply