You are currently viewing সূরা তাহরীম ও এর নিগুঢ়তম তত্ত্ব

সূরা তাহরীম ও এর নিগুঢ়তম তত্ত্ব

  • Post author:
  • Post last modified:June 29, 2021

কোরআন পড়ে আমাদের বোঝা উচিৎ কি রয়েছে এর প্রতিটি শব্দের অন্তরালে। অথচ অর্থ বোঝার চেয়ে আমাদের আগ্রহ যেন উচ্চারণের শাব্দিক প্রকাশে বিদ্যমান। সঠিক উচ্চারণে কোরআন পাঠ করলেও আমাদের অজানা থেকে যায় এর আভিধানিক মর্মার্থ। তাই কোরআন পড়ে আমাদের বোঝা উচিৎ কি পড়ে চলেছি আমরা আরবীয় উচ্চারণের সমধুর মুর্চ্ছনায়।

এ পর্যায়ে আজকে আমরা সূরা তাহরীম এর প্রতি দৃষ্টিপাত করবো।  “তাহরীম” এর আভিধানিক অর্থ “হারামকরণ”, অর্থাৎ যা হারাম করা হয়েছে। সূরা তাহরীম এর ঘটনাটি অত্যান্ত রহস্যময়। এখানে ঘটে যাওয়ার প্রকৃত ঘটনাটি প্রত্যেকটি তাফসীরে আড়াল করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রাচীন অনেক কিতাবে তা পরিস্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। সূরাটি পড়ে গেলে এর প্রকৃত তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। ব্যাপারটি একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করা হলে তা আড়ালেই থেকে যাবে। অন্যদিকে এই সূরাটি তেলাওয়াত করলেই যে আল্লাহর এবাদত করা হবে তা নয়। এই সূরার অর্থ ও নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপটেই তা সুস্পষ্ট। আসুন, ব্যাপারটি একটু তলিয়ে দেখি।

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِىُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَآ أَحَلَّ ٱللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِى مَرْضَاتَ أَزْوَٰجِكَ ۚ وَٱللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ (١) قَدْ فَرَضَ ٱللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَـٰنِكُمْ ۚ وَٱللَّهُ مَوْلَىٰكُمْ ۖ وَهُوَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْحَكِيمُ (٢) وَإِذْ أَسَرَّ ٱلنَّبِىُّ إِلَىٰ بَعْضِ أَزْوَٰجِهِۦ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِۦ وَأَظْهَرَهُ ٱللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُۥ وَأَعْرَضَ عَنۢ بَعْضٍ ۖ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِۦ قَالَتْ مَنْ أَنۢبَأَكَ هَـٰذَا ۖ قَالَ نَبَّأَنِىَ ٱلْعَلِيمُ ٱلْخَبِيرُ (٣) إِن تَتُوبَآ إِلَى ٱللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا ۖ وَإِن تَظَـٰهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ ٱللَّهَ هُوَ مَوْلَىٰهُ وَجِبْرِيلُ وَصَـٰلِحُ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۖ وَٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ بَعْدَ ذَٰلِكَ ظَهِيرٌ (٤) عَسَىٰ رَبُّهُۥٓ إِن طَلَّقَكُنَّ أَن يُبْدِلَهُۥٓ أَزْوَٰجًا خَيْرًا مِّنكُنَّ مُسْلِمَـٰتٍ مُّؤْمِنَـٰتٍ قَـٰنِتَـٰتٍ تَـٰٓئِبَـٰتٍ عَـٰبِدَٰتٍ سَـٰٓئِحَـٰتٍ ثَيِّبَـٰتٍ وَأَبْكَارًا (٥)

সূরা তাহরীম, ৬৬: ১-৫

বাংলা অনুবাদঃ ১. হে নবী! আল্লাহ্‌ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, আপনি তা হরাম করছেন কেন? আপনি আপনার স্ত্রীদের খুশী করতে চাইছেন। আল্লাহ্‌ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ২. আল্লাহ্‌ তো তোমাদের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন শপথ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা। আল্লাহ্‌ তোমাদের বন্ধু। তিনি সর্বজ্ঞ, মহাকৌশলী। ৩. স্মরণ কর, যখন নবী তাঁর স্ত্রীদের একজনের কাছে গোপনে কিছু কথা বলেছিলেন, তারপর যখন সে তা অন্যকে বলে দিল এবং আল্লাহ্‌ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে সম্পর্কে কিছু ব্যক্ত করলেন এবং কিছু ব্যক্ত করলেন না। অতঃপর যখন তিনি তা তার স্ত্রীকে বললেন তখন সে বললঃ আমাকে অবহিত করেছেন (আল্লাহ্‌) যিনি সর্বজ্ঞ সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ। ৪. তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তাই তোমরা উভয়ে আল্লাহর নিকট তাওবাহ্‌ করলে ভাল হয়। কিন্তু যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর তবে জেনে রেখ, আল্লাহই তাঁর বন্ধু এবং জিব্রাইল ও নেককার মু’মিনরাও, তাছাড়া অন্যান্য ফেলেশতারাও (তাঁর) সাহায্যকারী। যদি নবী তোমাদের সবাইকে তালাক দেন, তবে তাঁর প্রতিপালক অচিরেই তোমাদের পরিবর্তে তাঁকে তোমাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দিবেন, যারা হবে আজ্ঞাবহ, ঈমানদার, অনুগত, তাওবাহ্‌কারিণী, ইবাদতকারিণী, রোযাদার, বিধবা ও কুমারী (সূরা তাহরীম ৬৬: ১-৫ আয়াত)।

আগেই বলেছি তাহরীম অর্থ “হারামকরণ” সূরাটিতে হারামকরণ সংক্রান্ত ঘটনার উল্লেখ রয়েছে বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছে আত্‌-তাহরীম।

সূরাটি নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপটঃ এই সূরাটিতে দু’জন মহিলার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যারা হলেন হাফসা (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ)। এই দু’জনেই ছিলেন নবীজির কনিষ্ঠ স্ত্রীও দুই বান্ধবী।

শানে নুযূলঃ বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ্‌ নিজের স্ত্রীদের সাথে থাকার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। যখন হযরত হাফসার দিন আসলো, তখন তিনি তার মাতা পিতাকে দেখতে যাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ্‌ কাছে অনুমতি চাইলেন। রাসূল তাকে অনুমতি দিলে তিনি বাবা-মার সাথে দেখা করতে গেলেন। হাফসা চলে যাওয়ার পর পরই নবীজি মারিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অতঃপর হাফসার বিছানায় মারিয়ার সাথে সঙ্গম করলেন। ইতিমধ্যে হাফসা ‍ফিরে এসে দেখতে পেলেন তার ঘরের দরজা বন্ধ এবং জানতে পারলেন মারিয়া সেখানে নবীজির সঙ্গে অবস্থান করছেন। এতে তিনি অত্যান্ত উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করলেন। পাশের ঘর থেকে আয়েশা (রাঃ) ছুটে এসে জানতে চাইলেন তার কান্নার কারণ। তৎক্ষণাত নবীজি ছুটে এসে হাফসার মুখে হাত দিয়ে তার কান্না থামাতে চেষ্টা করলেন ও শপথ করলেন যে, তিনি আর কখনো এ কাজ করবেন না। অর্থাৎ মারিয়া তার জন্য হারাম হয়ে গেলো। তবে তিনি অনুরোধ করলেন যেন হাফসা আর কাউকে সে কথা না বলে। কিন্তু হাফসা ঘটনাটি আয়েশাকে জানিয়ে দিলে তারা দু’জনেই নবীজির বিরোধীতা করতে লাগলেন। এতে নবীজি অত্যান্ত রাগান্বিত হলেন ও শপথ করলেন যে আগামী এক মাস তিনি তার স্ত্রীগণের ঘরে প্রবেশ করবেন না। এরপর রাসুলুল্লাহ তাদের হতে আলাদা থাকতে লাগলেন। তখন আল্লাহ্‌ তায়ালা আয়াতটি নাযিল করলেন। (সাফওয়া, আসবাব, কুরতুবী, তাবারী সাবী)।

বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রমুখ হতে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ্‌ প্রত্যেহ নিয়মিতভাবে আসরের পর দাঁড়ানো অবস্থায়ই স্ত্রীগণের কাছে কুশল জিজ্ঞাসার জন্য গমন করতেন। একদিন হযরত যয়নবের কাছে একটু বেশী সময় অতিবাহিত করলেন এবং মধু পান করলেন। এতে আমার মনে ঈর্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল এবং আমি হযরত হাফসার সাথে পরামর্শ করে স্থির করলাম যে, তিনি আমাদের মধ্যে যার কাছেই আসবেন সেই বলবে, আপনি “মাগাফী” পান করেছেন। মাগাফী হলো এক ধরনের বন্য মধু যা ছিল দুর্গন্ধযুক্ত। রাসুলুল্লাহ্‌ আসা মাত্রই আমরা পরিকল্পনামতো কাজ করলাম, তাকে মাগাফীর দোষে দোষী সব্যস্ত করলাম। অতঃপর তিনি মধু খাবেন না বলে কসম করলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে উল্লেখিত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

আল্লামা ইবনে হাজার (রাঃ) বলেছেন, আলোচ্য আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার কারণ উভয় ঘটনা হতে পারে। (আসবাব, সূয়ূতী)। দ্বিতীয় কারণটি প্রথম কারণ হতে সনদের দিক দিয়ে অধিক সহীহ্‌ ও নির্ভরযোগ্য হলেও মুফাসসিরগণের কাছে প্রথম কারণটিই অধিক প্রসিদ্ধ। দ্বিতীয় কারণটিকে অনেকেই এ সূরা নাযিল হওয়ার কারণ হিসেবে অস্বীকার করেছেন এবং তাঁরা বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য করে প্রথম কারণকেই এ সূরা নাযিল হওয়ার কারণ বলে মত পোষণ করেছেন।

মধু পান হারামকরণের মাধ্যমে নবীজি কোনো স্ত্রীকে খুশী করতে চেয়েছিলেন এটা অবান্তর। মধু পান হারাম করেছিলেন মূলত দুগর্ন্ধের কথা শুনে-স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়। সুতরাং স্ত্রীকে খুশী করানোর জন্য মারিয়াকে হারাম করাই যুক্তিসঙ্গত।

আলোচ্য সূরায় রাসূলের স্ত্রীদের প্রতি যে কঠোর হুঁশিয়ারী দেওয়া হয়েছে এবং তাদেরকে যে ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে তা হতে বোঝা যায় যে, রাসুলুল্লাহ্‌ এর স্ত্রীগণের মধ্যে ঈর্ষা ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে রাসুলুল্লাহ্‌ কষ্ট পেয়েছিলেন এবং তাঁর কোনো দাসীকে নিজের জন্য হারাম করে নিয়েছিলেন স্ত্রীদেরকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। মধু পান হারাম করার কারণে স্ত্রীদেরকে এ রকম কঠোর হুশিয়ারী দান অসম্ভব মনে হয়। এ সব কারণেই আল্লামা ইবনে কাছীর (রাঃ) বলেছেন, অর্থাৎ মধু পানের ব্যাপারটিকে সূরাটি নাযিল হওয়ার কারণ হিসেবে গ্রহণ করা কঠিন।

সূরাটির বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্যঃ

কোরআন শরীফের সূরাগুলির মাঝে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এতে আল্লাহ্‌ তায়ালা রাসূলে কারীম এর পবিত্রা স্ত্রীদের কতিপয় ঘটনা উল্লেখ করেছেন।

এখানে উল্লেখ যে, হারাম-হালাল বা জায়েজ ও নাজায়েজ সম্পর্কে সীমা নির্ধারণ করার বিশেষ ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে সুনিশ্চিতরূপে নিবদ্ধ রয়েছে, এ বিষয়ে সাধারণ মানুষতো দূরের কথা, নবীর হাতেও এটার এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। আল্লাহর ইঙ্গিত ব্যতীত নবীও নিজ ক্ষমতা বলে কোনো হালালকে হারাম করার ক্ষমতা পান নি। আল্লাহর সাথে যোগাযোগ ব্যতীত কোনো কাজ করার ক্ষমতা নবীজিকে দেওয়া হয়নি। (তাফসীরে জালালাইন,ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬০৩,৬০৪) দ্রষ্টব্য।

এবার আসুন দেখা যাক তাফসীরে জালালাইনের অনুবাদে কি বলে। হুবহু তুলে দিচ্ছি আপনাদের বোধগম্যের জন্য বলা হয়েছে—

১. “হে নবী! আল্লাহ্‌ আপনার জন্য যা হালাল করেছেন, আপনি তাকে হারাম করছেন কেন?” অর্থাৎ মারিয়া কিবতিয়াকে, যে আপনার জন্যে বৈধ। হাফসা (রাঃ) অনুপস্থিতিতে আপনি তার সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়েছেন। আর সে যখন ফিরে এসে দেখল যে, এ সব কিছু তার আবাসগৃহে এবং তারই শয্যায় সংঘটিত হয়েছে। তার নিকট এটা বিরক্তিকর মনে হলো। তখন আপনি তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলেছেন, ‘আমার জন্য সে অর্থাৎ মারিয়া হারাম।’ আপনি কি চাচ্ছেন তাকে হারাম করার মাধ্যমে আপনার স্ত্রীগণের সন্তুষ্টি অর্থাৎ তাদের খুশী ও সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল ও দয়ালু তিনি আপনার এ হারাম করা ক্ষমা করে দিয়েছেন।

২. আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন বিধান রেখেছেন তোমাদের শপথ হতে মুক্তিলাভ করার সূরা মায়িদায় উল্লেখিত কাফফারা আদায়ের মাধ্যমে তা ভঙ্গ করার ব্যবস্থা করেছেন। দাসীটিকে হারাম করাও শপথের অন্তভূর্ক্ত। রাসুলুল্লাহ্‌ এ ব্যাপারে কাফফারা আদায় করেছেন কিনা? মুকাতিল (রাঃ) এর বর্ণনা মোতাবেক তিনি মারিয়াকে হারাম করার বিষয়ে একটি ক্রীতদাস মুক্ত করেছেন। আর হাসানের বর্ণনা মোতাবেক তিনি এ জন্য কোনো কাফফারা আদায় করেননি। যেহেতু এটা তাকে ক্ষমা করা হয়েছে। আর আল্লাহ্‌ তোমাদের সহায় সাহায্যকারী আর তিনিই সর্বজ্ঞ, বিজ্ঞানময়।

নবী করীম মধু নাকি মারিয়া কিবতিয়াকে হারাম করেছেন? এ প্রশ্নে আল্লামা জালালুদ্দীন মহল্লী (রাঃ) বলেন, হযরত মুহাম্মদ তার দাসী মারিয়া কিবতিয়াকে তার জন্য হারাম করার প্রসঙ্গেও আল্লাহ্‌ তায়ালা আয়াতটি নাযিল করেছিলেন (তাফসীরে কাবীর, পৃষ্ঠা ৬০৬)।   

ইমাম নাসায়ী (রাঃ) হযরত আনাস (রাঃ) হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, রাসূলে করীমের একটি দাসী ছিল, যার সাথে তিনি যৌন সম্পর্ক রাখতেন, হযরত হাফসা ও আয়েশা (রাঃ) এর কারণেই শেষ পর্যন্ত তিনি সেই দাসীকে নিজের জন্য হারাম করেছিলেন (তাফসীরে জালালাইন, পৃষ্ঠা ৬০৬) দ্রষ্টব্য।

মজার ব্যাপার হলো যদি আমরা সাধারণ অনুবাদ পড়ি তাহলে আসল চিত্রটি কখনো পরিস্কার হবে না। পরিবর্তে আমরা অন্য চিত্র ও ব্যাখ্যা খুঁজে পাই সেখানে। কিন্তু কিছু কিছু নামকরা তাফসীরকারকগণ ব্যাপারটি খোলাসা করে বলেছেন নির্দ্ধিধায়। তার মধ্যে জালালাইন অন্যতম। প্রথমে দেখা যাক সাধারণ অনুবাদটি কি বলে। এখানে বলা হয়েছে— “স্মরণ কর যখন নবী তাঁর স্ত্রীদের একজনের কাছে গোপনে কিছু কথা বলেছিলেন, তারপর সে তা অন্যকে বলে দিল এবং আল্লাহ্‌ নবীকে তা জানিয়েদিলেন, তখন নবী সে সম্পর্কে কিছু ব্যক্ত করলেন এবং কিছু ব্যক্ত করলেন না। অতঃপর যখন তিনি তা তার স্ত্রীকে বললেন তখন সে বললঃ কে আপনাকে এ ব্যাপারে অবহিত করেছেন? নবী বললেনঃ আমাকে অবহিত করেছেন (আল্লাহ্‌) যিনি সর্বজ্ঞ, সর্ব বিষয়ে অভিজ্ঞ”, এই অনুবাদের অন্তরালে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক অজানা তথ্য।

এবার দেখা যাক তাফসীরে জালালাইন কি বলে এই আয়াতের বাংলা অনুবাদে। আর স্মরণ করো যখন নবী তাঁর কোনো এক স্ত্রীর নিকট গোপনে বলেছিলেন সে হচ্ছে হাফসা (রাঃ) একটি কথা তা হলো, মারিয়া কিবতিয়াকে হারাম করা এবং তিনি হাফসা (রাঃ) কে বলেছিলেন এটা কাউকে বলো না। অতঃপর যখন সে এটা অন্যকে বলে দিল আয়েশা (রাঃ) কে এ ধারণায় যে, এতে কোন দোষ নেই।  

আর আল্লাহ্‌ তাঁর নিকট প্রকাশ করে দিলেন তাঁকে অবহিত করলেন সে বিষয়, তখন তিনি এ সম্পর্কে কিছু ব্যক্ত করলেন হাফসা (রাঃ) এর নিকট আর কিছু হতে বিরত থাকলেন স্বীয় সৌজন্যবোধের কারণে। অতঃপর যখন তিনি তা তার সে স্ত্রীকে জানালেন, সে বলল, আপনাকে কে এ সংবাদ দিয়েছে? তিনি বললেন, আমাকে সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত সত্তা সংবাদ দান করেছেন অর্থাৎ আল্লাহ্‌ তায়ালা। (তাফসীরে জালালাইন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬১২) দ্রষ্টব্য।

একটু ভেবে দেখুন তো প্রথম অনুবাদটির সাথে দ্বিতীয়টির মিল খুঁজে পান কি না? প্রথম অনুবাদটিতে বোঝার উপায় নাই যে ঘটনাটি ঘটেছে মারিয়া কিবতিয়াকে হাফসা-র ঘরে, তারই বিছানায় সঙ্গম করার বিষয়ে।

এটাই যদি হয়ে থাকে আমাদের এবাদতের নমূনা তাহলে আমার বলার কিছু নাই। আর যদি তা আপত্তিজনক মনে হয়ে থাকে আপনার কাছে তাহলে নিজেই বিবেচনা করে দেখুন আপনার এই এবাদত কি আল্লাহর আরশ স্পর্শ করার অধিকার রাখে?

এ কারণেই বলছিলাম কোরআন বুঝে পড়ার চেয়ে তা পড়ে বোঝার যথার্থতা অপরিসীম।

জালালাইন তার ব্যাখ্যায় বলেছেন— এখানে ‘হাদীদ’ বলতে হযরত মারিয়াকে হারাম করার কথা বুঝানো হয়েছে। আর একজন স্ত্রী বলতে হযরত হাফসা (রাঃ) কে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ নবী করীম হযরত হাফসার কাছে হযরত মারিয়াকে হারাম করার ঘটনা বা ব্যাপারটি অন্য কাউকেও না বলার অনুরোধ করেছিলেন। (তাফসীরে জালালাইন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা ৬১৩) দ্রষ্টব্য।

উল্লেখিত ঘটনাটি কিন্ঞ্চিত জানাজানি হওয়ায় লজ্জায়, ক্ষোভে নবীজি তার স্ত্রীদের তালাকের কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে ব্যাপারটি স্ত্রীদের কাছে আত্নঘাতি হয়ে উঠেছিল। দোষ করেছেন নবীজি স্বয়ং অথচ দোষটি হলো স্ত্রীদের! একেই বলে কপাল। অবৈধ কাজ করলেন নবীজি আর হারাম করা হলো স্ত্রীদের!

বস্তুত, নবীজি মারিয়াকে নিজের জন্য হারাম করতঃ তার কাছে না যাবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি তার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং আমরা জানি যে, মারিয়ার সাথে নবীজির মিলনের ফলশ্রুতিতে মারিয়া ‍নবীজিকে একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন তার সঙ্গম ফসল হিসেবে যার নাম ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে শিশু ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ মাত্র আঠারো মাস বয়সে অসুস্থতায় মৃত্যু বরণ করেন।

একটি বিষয়ে সর্বশেষে কিন্ঞ্চিত আলোচনা করতে চাই। আর তা হলো মারিয়ার সাথে নবীজির এই অবৈধ কাজের খেসারত হিসেবে আল্লাহ্‌ তাকে কিছুই বললেন না। বরং এই অবৈধ মিলনে যে স্ত্রী ব্যক্তিটি বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হলো, তাকেই তালাক দেবার কথা বললেন তিনি। একে আল্লাহ্‌ তায়ালাও কিভাবে সমর্থন দিয়েছেন? এই কাজটি যদি অন্য কেউ করতো তাহলে কি তার বিচার হতো না? হতো না কি চাবুক মারার পরিকল্পনা কিংবা পাথর মেরে হত্যার বিধান?

আমরা ইতিহাসে দেখেছি আল্লাহর নবী হযরত দায়ুদ (আঃ) যখন যেনা (যৌন পাপ) করেছিলেন এবং তা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিলো আল্লাহ্‌ তখন তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন। অতঃপর রাজা দায়ুদ (আঃ) দিন-রাত আল্লাহর দরবারে মাথা ঠুকে সেজদায় ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) ও অন্যান্য প্রাচীনকালের নবীদেরও পাপের কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছিল। অথচ মুহাম্মদ (সাঃ) এত বড় একটা জঘন্য কাজ করার পরও স্ত্রীদের কাছে তথা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে চোখ রাঙিয়ে কথা বলেছেন আর তালাকের ভয় দেখিয়েছেন।

ইসলামের পান্ডিত্য অর্জনকারী হুজুরেরা এ বিষয়ে কিভাবে নিরুত্তাপ থাকতে পারেন তা আমার বোধগম্য নয়। তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ব্যাপারটি যদি আমাদের মাঝে সংঘটিত হয়, কোন স্ত্রী তা মেনে নেবে না। এর মধ্যে দিয়ে আল্লাহর পবিত্রতা বা মহত্বত্তা প্রকাশের সুযোগটা কোথায়? নবীজির প্রতিটি কর্মকান্ড অনুসরণ করাই যদি আমাদের জন্য সুন্নত হয়ে থাকে তাহলে এহেন কাজটি করতে বাধা কোথায় অন্ধ অনুসারীদের? আল্লাহর বান্দারা তাই আজ নির্দ্ধিধায় নবীজিকে অনুসরণ করে চলেছে নিরবে। ভোগ, কামনা-বাসনা ও মাংসের লোলুপনা যেখানে বিদ্যমান সেখানে পবিত্রতার অবস্থানটি কোথায়? আমরাই তো বলি তেলে আর জলের মিশ্রণ হয় না কখনো। একইভাবে বলতে পারি পবিত্রতা আর অপবিত্রতার মিশ্রণ কখনো স্বম্ভব নয়। আর এটা নিশ্চিত যে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা কখনো অপবিত্রতায় নিজেকে জলান্জ্ঞলি দিতে পারেন না।

অবস্থাদৃষ্টে একথা দৃঢ়ভাবে বলা যুক্তিসঙ্গত যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তার নিজের স্বার্থে আল্লাহকে ব্যবহার করেছেন আর বলেছেন আল্লাহ্‌ তাকে স্ত্রীদের বিদ্রোহের কথাটি জানিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও, তাকে আরো ভালো ও সতী নারী দেবার জন্য মনস্থ করেছেন যদি মুহাম্মদ তার স্ত্রীদের তালাক দেন। ব্যাপারটি হাস্যকর হলেও জন্মান্দ্ধ ইসলামী সৈনিকেরা তা চোখে দেখেন নাই। বোঝারও চেষ্টা করেন নাই। এভাবেই চলছে, চলবে এভাবেই যদি না আমরা বুঝি সত্য-মিথ্যার তফাৎটি।

ইতিমধ্যে নবীজি স্বীয় পালক পুত্রবধুকে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে নিজের ঘরণী করেছেন। দাওয়াত করে তিনশত মানুষকে খাইয়েছেন আর তৃপ্তিসহকারে তাকে ভোগ করেছেন হালাল বস্তু হিসেবে। বেচারা যায়দ (পালক পুত্র) তা নিরবে সহ্য করেছে আর অসহায়ত্বের চাবুকাঘাতে মর্মাহত হয়েছে। এখানেও আল্লাহর যথারীতি সমর্থন পাওয়া যায়।

এর পূর্বে তিনি ছয় বছরের নাবালিকা আয়েশা (রাঃ) কে বিয়ে করে নয় বছর বয়সে তার সাথে বাসর রাত অতিবাহিত করেছেন সেই সময় তার বয়স ছিল চুয়ান্ন বছর। এ যেন এক নানা-নাতনির বয়সের ব্যবধান! তবুও তা হালাল হয়েছে এই বিশেষ দয়াপ্রাপ্ত নবীজির কারণে। কেউই একটু উচ্চবাক্য করেন নাই যেন তাতে আল্লাহ্‌ নারাজ না হোন। নিঃসন্দেহে নবীজি প্রমাণ করেছেন যে, সুগন্ধি ও নারী তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু।

সে যাই হোক, আমরা যখন এই “হারামকরণ” সূরা বা সূরা তাহরীম পড়ে নামাযে দাঁড়াই তখন কি বুঝতে পারি আমরা কি বলে চলেছি আল্লাহ্‌ তায়ালাকে? মোটেও না। এ কারণেই আবারো বলছি কোরআন না বুঝে যত্নসহকারে পড়ার চেয়ে তা পড়ে বোঝা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, এ দিকটিতে একটু মনোযোগ দেই। আর প্রার্থনা করি যেন আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের অন্তঃর্চক্ষু উম্মোচন করে দেন সত্যের জ্যেতির্ময় আলোর প্রভায়।

এই সূরাটি বিশ্লেষণে প্রকাশ পেয়েছে যে, প্রথমতঃ নবীজি মারিয়া কিবতিয়াকে বলাৎকার করেছেন। নতুবা অন্য অর্থে তিনি যেনা (যৌন পাপ) করেছেন। দু’ভাবেই তিনি অপরাধী হিসেবে দন্ডনীয়। দ্বিতীয়তঃ তিনি তার স্ত্রী হাফসা-র সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, তার অজান্তে তারই দাসীর সাথে শারীরিক মিলনের মাধ্যমে। তৃতীয়তঃ তিনি মিথ্যা কথা বলে হাফসাকে তার পিতার বাসায় পাঠিয়েছেন যেন তিনি এ কাজটি গোপনে করতে পারেন। এতে করে তিনি বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততা দু’টোকেই গলা টিপে হত্যা করেছেন। চতুর্থতঃ তিনি নিজেকে সবার সামনে নিঃষ্পাপ প্রতীয়মান করার জন্যে স্ত্রীদের সঙ্গ ত্যাগ করেছেন ও মারিয়াকে হারাম হিসেবে গণ্য করেছেন।

ব্যাপারটি যদি অন্য কারো দ্বারা সংঘটিত হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তাকে পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ তিনিই দিতেন প্রথমে। সত্যি কি না? আজকে তাকিয়ে দেখুন আমাদের আলেম-ওলামারা কি করে চলেছেন লম্বা কোর্তার অন্তরালে। তারাও কি কেউ নির্দ্ধিধায় বলতে পারবেন তারা এসব কর্মকান্ড বরদাস্ত করতে পারেন না?

যে কাজটি অন্যের জন্য ধর্ষণযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে সে কাজটি নবীজির জন্যে ঢাকা দিয়ে রাখার প্রচেষ্টা কেন? এখানে কি সত্যের সাথে প্রতারণা করা হচ্ছে না? একটি বলাৎকার বা যেনা করার ঘটনাকে কি নিপুণভাবে আমরা ‘মেগাফী’ নামক বন্য মধুর আবরণে মুড়ে দিয়েছি! এতে করে আমরা কি প্রতারণা করে চলেছি না মানুষের সাথে?       

আপনার পছন্দ হতে পারে: আপনার জন্য হালাল আর সবার জন্য হারাম

Leave a Reply