You are currently viewing শয়তানের আয়াত ও নবীজির বিভ্রান্তি

শয়তানের আয়াত ও নবীজির বিভ্রান্তি

  • Post author:
  • Post last modified:August 11, 2021

মাদের অজান্তেই কখন যে আমরা শয়তানের হাতে পড়ি তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মুশকিল হলো যখন আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই কার সাথে হচ্ছে আমাদের কথোপকথন আর সেইটানে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি সেটাও অজানা। মানুষ হিসেবে এই দূর্বলতা আমাদের সবার মাঝেই রয়েছে। কিন্তু যখন বিশেষ কোনো ব্যক্তি শয়তানের ফাঁদে পা দেন, তখন শুধু তিনি নন তার অনুসারীরাও পড়ে শয়তানের মোক্ষম বলয়ে।

এখন দেখা যাক আমাদের নবীজির অবস্থাটা। তিনিও অজান্তে পড়েছেন শয়তানের হাতে আর অবনত হয়েছেন তার চরণে। চলুন দেখা যাক এ বিষয়ে কি বলে কোরআনের আয়াতে।

أَفَرَءَيْتُمُ ٱللَّـٰتَ وَٱلْعُزَّىٰ (١٩) وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلْأُخْرَىٰٓ (٢٠) أَلَكُمُ ٱلذَّكَرُ وَلَهُ ٱلْأُنثَىٰ (٢١)

বাংলা অর্থঃ  তোমরা কি ভেবে দেখেছ ‘লাত ও ওযযা’ সন্বন্ধে, এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সন্মন্ধে? তোমরা মনে কর কি পুত্র সন্তান তোমাদের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহর জন্য?

বিষয়টির প্রেক্ষাপট নিম্নরূপঃ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন লক্ষ্য করলেন কুরাইশরা, যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তারা ধীরে ধীরে তাদের পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে লাগলো, তখন তিনি কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে একদিন তিনি যখন কাবা ঘরে তাদের কতিপয় বয়োজষ্ঠ্যে ব্যক্তিদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন উক্ত আয়াতটি উল্লেখ করেন এইভাবে।

উল্লেখ্য যে এগুলি প্রাচীন আরবের মুশরিকদের তিনটি দেবীর নাম। “তাহারা ইহাদিগকে আল্লাহর কন্যা বলিয়া বিশ্বাস করিত”- (সূত্রঃ আল কুরআনুল করিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৮৭০)।

এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আশরাফ আলী খানভী-র দেওয়া টীকাটি প্রণিধানযোগ্য। টীকাটি নিম্নরূপঃ দিনের আলোকে পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় উন্মুক্ত চক্ষে মুহাম্মদ (সাঃ) যে বিদ্যা দর্শন করলেন তার প্রতি তাঁর অন্তর এ সাক্ষ্য দিল যে, এ দৃষ্টি-ভ্রম বা কোন দানব বা শয়তান আমার দৃষ্টিতে উদয় হয়েছে, অথবা আমার সামনে কোন কাল্পনিক মূর্তি উদিত হয়েছে। আর আমি জাগ্রত অবস্থায় কোন স্বপ্ন-দর্শন করছি। বরং তাঁর চক্ষু যে দৃশ্য অবলোকন করছিল তাঁর অন্তঃকরণ যথার্থরূপেই তা উপলদ্ধি করছিল। এ বিষয়ে তাঁর অন্তঃকরণে বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয় ছিল না- যে তিনি যাকে দেখেছিলেন, তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে জিবরাইল (আঃ), এবং যে বাণী তিনি দান করেছিলেন তা ছিল আল্লাহ্ তায়ালারই পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ বাণী (সূত্রঃ নূরানী কোরআন শরীফ, পৃষ্ঠা ৭৭৬, সূরা নাজ্বম, ৫৩:১৯-২১ আয়াত)।

এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) দিবালোকে পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় উন্মুক্ত চক্ষে দেখেছিলেন (তাঁর কথানুযায়ী) জিবরাইল (আঃ) কে এবং গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ বাণী। সে কারণেই তিনি এই আয়াতসমূহ উচ্চারণ করেছিলেন কা’বা ঘরে উপস্থিত সেই বয়োজষ্ঠ্যেদের কাছে।

কুরাইশ যখন মুহাম্মদ (সাঃ) এর মুখে এ আয়াতটি শুনলো তখন তারা আনন্দে ও আতিশয্যে পূর্ণ হলো। এরপরে মুহাম্মদ (সাঃ) তার পরবর্ত্তী আয়াতগুলি বলে গেলেন। এর আয়াতগুলি শেষ করে সেজদা দিলেন। সব মুসলমান ও মূর্ত্তি পূজারীরাও তাঁর অনুকরণে সেজদা করলেন। প্রত্যেকে যারা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেজদা করলেন। শুধুমাত্র ওয়ালিদ-বিন-আল মাযিরা এবং আবু উহাইয়া সায়িদ বিন-আল-আস ছাড়া।

তাদের দু’জনে একমুঠো মাটি নিলেন ও তাদের কপালে ঠেকালেন। কারণ, তাঁদের দু’জনেই অতি বৃদ্ধ ছিলেন ও নিজে সেজদা দিতে অক্ষম ছিলেন। কুরাইশরা বললো, মুহাম্মদ (সাঃ) আমাদের প্রতিমার নাম উল্লেখ করেছেন ও তাদের যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছেন। যদি মুহাম্মদ আমাদের প্রতিমাকে বিবেচনা করেন তবে আমরা তার সাথে রয়েছি।

এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় জিবরাইল ফেরেশতা মুহাম্মদ (সাঃ) এর  কাছে এসে বলেন- ও মুহাম্মদ, আপনি এটা কি করেছেন? আপনি মানুষের কাছে আয়াত নাযিল করেছেন যা আমি আপনাকে দেই নাই। এতে করে নবীজি অত্যান্ত বিমর্ষ হলেন এবং আল্লাহর শাস্তির বিষয়ে ভীত হলেন (আল-রাজীর তফসীর)।

The Idols of Kaaba
যুদ্ধ ও সমৃদ্ধির দেবী আল-লাত এর দু’পাশে রয়েছে ভাগ্য, সময় আর মৃত্যুর আর দুই দেবী আল-মানাত ও আল-উযযা। আল-লাত ছিল গ্রিক দেবী এ্যাথিনা ও তার রোমান জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী মিনার্ভার সমকক্ষ। লাত আর মানাত এর বোন আল-উযযা ছিল গ্রিক দেবী এ্যাফ্রোডাইটি ও রোমান দেবী ভিনাসের সমকক্ষ। শক্তি আর ভাগ্যের দেবী এ্যানাঙ্কি’র আরবীয় সমকক্ষ ছিল আল-মানাত। তথ্য: উইকিপিডিয়া 

Satanic Verse

বিষয়টি ইবনে ইসহাক, ইবনে সা’দ, আল-তাবারি, ইবনে তায়ামিইয়াহ ও বোখারী তাদের স্বস্ব লেখণীতে প্রকাশ করেছেন। ইবনে ইসহাক তাঁর সীরাত রসুলুল্লাহ পুস্তকে পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬ বিস্তারিতভাবে লিখেছেন।

ইবনে সা’দ তাঁর কিতাব আল-তাবাকাত আল কাবির, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৭ তে বর্ণনা করেছেন।

পরবর্ত্তীতে জিবরাইল আসে এবং তাঁকে বলে, “মুহাম্মদ, এটা আপনি কি করেছেন? আপনি এদের কাছে যা বলেছেন তা আমি আল্লাহর কাছে থেকে আনি নাই এবং আপনি যা বলেছেন তা তিনি বলেন নাই” (সীরাত রসুলুল্লাহ্, ইবনে ইস্হাক, পৃষ্ঠা ১৬৬)।

আল-তাবারি তা আল-তাবারি-র ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করেছেন, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ১১১:  Now the apostle was anxious for the welfare of his people, wishing to attract them as far as he could he meditate on the project and longed for it and it was clear to him. (Ibn Ishaq, Sirat Rasenl Allah, page 165).

He was one day sitting alone when he expressed a desire: I wish, Allah had not revealed to me anything distasteful to them (Ibn Sa’d, Kitab Al-Tabaqat Al-Kafir, page 237).

The messenger of God was eager for the welfare of his people and wished to effect a reconciliation with them in whatever ways he could and he longed in his soul that something would come to him from God which would reconcile him with his tribe….and he debated with himself and fervently desired such outcome. (Al-Tabari, The History of Al-Tabari, Val-Vi, pp 107-108 দ্রষ্টব্য।

এই আয়াতটিতে মন্তব্য করতে গিয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- আতা বলেছেন যে, একটি শয়তান যার নাম আল-আবিয়াদ (সেই সাদাটি) মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে এসেছিল জিবরাইলের বেশে এবং তাঁকে এই আয়াতগুলি দিয়েছিল যা মুহাম্মদ (সাঃ) তেলাওয়াত করেছেন। পরে জিবরাইল এসে তাঁকে বলেছিলেন- আমি আপনার কাছে এ আয়াতগুলি আনি নাই। তখন মুহাম্মদ (সাঃ) স্বীকার করেছেন যে, একজন জিবরাইলের বেশে তাঁর কাছে এসে কথাগুলি তার মুখে দিয়েছে (আল-রাজীর তফসীর দ্রষ্টব্য)।

ইসলামী বিশেষজ্ঞরা দাবী করেন যে, মুহাম্মদ (সাঃ) অনুধাবন করতে পারলেন যে, তাঁর মুখের কথায় শয়তান বাক্য প্রক্ষেপণ করেছে যা জিবরাইলের কাছ থেকে আসা নয়। তিনি জিবরাইলের কাছে স্বীকার করেছেন যে, “আমি মুখ খুলেছি আর শয়তান তাতে বাক্য প্রক্ষেপণ করেছে”। এ ব্যাপারে মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন যে, তাঁর অন্তর ভরে উঠেছিল শয়তান দ্বারা। তাই তিনি এ কারণে দিনে সত্তরবার আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন (সূত্র আলবাণী, মিশকাত, হাদীস নং ২৩২৪)।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ একটি আয়াত নাযিল করেন এবং মুহাম্মদ (সাঃ) কে শান্ত করেন এই বলে- “আমি তোমার পূর্বে যে সমস্ত রাসুল বা নবী প্রেরণ  করেছি তারা যখনই কিছু পাঠ করেছে তখনই শয়তান তাদের পাঠে কিছু প্রক্ষিপ্ত করে আল্লাহ্ তা বিদূরিত করেন। ’ পরে আল্লাহ্ তাঁর আয়াতসমূহকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (সূরা হাজ্ব ২২ঃ ৫২ আয়াত দ্রষ্টব্য)।

একথা অনস্বীকার্য যে, বিষয়টি অত্যান্ত জটিল ও সংবেদনশীল। কারণ, এটি অনেকের কাছে “শয়তানের আয়াত” হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ, শয়তান অন্ততঃপক্ষে নবীজিকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত ও প্রতারিত করেছে। অন্য অর্থে তিনি শয়তানের কৌশল অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছেন ও তার প্ররোচনায় ‘ভুল’ আয়াত উচ্চারণ করেছেন।

এছাড়াও তিনি জিবরাইল ফেরেশতাকেও চিনতে ভুল করেছেন। এ সমস্ত বিষয়গুলি মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবী হিসেবে ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরে। এরই প্রেক্ষিতে তাঁকে আল্লাহর দরবারে শতবার ক্ষমা চাইতে হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন শয়তানের চেহারা ও আয়াত যদি তাঁকে বিভ্রান্ত করে থাকে তবে কতবার তিনি এভাবে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন? আর কতবারই বা এহেন ভুল করেছেন?

সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপারটি হচ্ছে- তিনি যখন শয়তানকে চিনতে ভুল করলেন বা শয়তানের বাক্য উচ্চারণ করলেন এবং মূর্ত্তিগুলিকে সেজদা করলেন তার বর্ণনা করা হয়েছে সূরা নজ্বম এ। অর্থাৎ ৫৩ নম্বর সূরায়। পরবর্ত্তীতে আল্লাহ্ যখন তাঁকে সান্ত্বনা দান করে আরেকটি আয়াত নাযিল করলেন, তখন তা প্রকাশ পেল সূরা হাজ্ব বা ২২ নম্বর সূরায়! অর্থাৎ, বিষয়টি এমন দাঁড়ালো যেন ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার আগে সমাধানটি নাযিল হয়েছে।

এটি একটি অবিশ্বাস্য কান্ড বৈ কিছু নয়। তাই ইসলাম বিশেষজ্ঞরা মুখ খুলতে চান না এ বিষয়ে। বরং ‘নাউজুবিল্লাহ্ বলে রাগে মুখ ফিরিয়ে নেন।

উল্লেখিত আয়াতসমূহ শয়তানের বাক্য হোক বা না হোক তা বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় থাক। কিন্তু এসব যখন আমরা সুর করে আল্লাহর সামনে তুলে ধরি বা তেলাওয়াত করি তাতে কি আল্লাহ্ তায়ালা গর্বিত অনুভব করেন বলে আপনার মনে হয়? এতে তাঁর গর্বিত হওয়ার কিছু নেই সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হলেও কি তা বন্ধ রেখেছি? অন্ধের মতো সেসব কি আমরা প্রতিনিয়ত তাঁকে পড়ে শোনাই না? শোনাই তো, আর মনে করি অশেষ সওয়াব হাসিল হয়েছে তাতে। কিন্তু আসলেই কি তাই?

তাই বলছিলাম অন্ধের মতো আরবী উচ্চারণ করলেই আল্লাহর এবাদত করা হয় না। প্রকৃতপক্ষে যে কোন ভাষায় (যে ভাষা আমরা বুঝি) তাঁর প্রশংসা গৌরব করাই এবাদত। আর তাঁর প্রশংসা গৌরব করার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁকে যথার্থ সম্মান দিতে পারি। এ কারণেই বলেছি কোরআন বুঝে পড়ার চেয়ে, পড়ে বোঝার প্রয়োজনীয়তা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পক্ষান্তরে, নামাযে দাঁড়িয়ে বা এবাদতের মধ্যে আমরা যখন মনদিয়ে সুর করে এই আয়াতসমূহ পড়ে যাই তখন কি আমরাও একইভাবে কুরাইশ প্রতিমার প্রশংসা করি না যার জন্যে নবীজিকে ধমক খেতে হয়েছিল জিবরাইলের কাছে? এখনও কি চোখ-কান বন্ধ রেখে এসব আয়াতসমূহ আমাদের পড়ে যেতে হবে? এটা শয়তানের প্ররোচিত বাক্য জানা সত্তেও? একটু ভেবে দেখার বিষয় বৈকি?

বলছিলাম শয়তানের ফাঁদে পড়ার বিষয়ে। আমরা অনিবার্য কারণে তার ফাঁদে প্রতিনিয়তই পা দেই, দিচ্ছি। কিন্তু নবীজি কিভাবে তার ফাঁদে পড়ে তার প্রতি সমর্পিত হলেন? কিভাবে তিনি চিন্তে ব্যর্থ হলেন শয়তানের কৌশল। তাছাড়া কিভাবে তিনি সেজদা করলেন কুরাইশ প্রতিমার প্রতি সেটাই বড় প্রশ্ন। কতদিন তিনি স্বয়ং শয়তানের ফাঁদে পা দিয়েছেন তা আমাদের অজানা। কিন্তু তিনি জিবরাইলকেও  চিনতে ভুল করেছেন কিভাবে? কার কথা শুনে এসেছেন তিনি এতকাল? বিষয়টি একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন।

আরও জানুন: বাবা ও পুত্রবধুর বিবাহ: নবীজির হালালীকরণ বিষয়ক 

Leave a Reply