You are currently viewing কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (১ম খণ্ড)

কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (১ম খণ্ড)

  • Post author:
  • Post last modified:August 6, 2021

কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি সম্পর্কে কম-বেশী প্রত্যেকের কিন্ঞ্চিৎ জ্ঞান থাকা দরকার। আমরা সবাই জানি যে, কোরআন আল্লাহর কাছ থেকে আসা একটি বিশেষ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে নাজিল হয়েছে ২৩ বছর ধরে, ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয়ে। অনেকে একথা বলে থাকেন যে, শবে কদরের রাতে নাজিল হয়েছে এই ধর্মগ্রন্থ। কথাটির যুক্তি আছে বটে তবে সত্যতা নেই। কারণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনের শেষ পর্যন্ত কোরআন নাজিল হয়েছে ধাপে ধাপে, পর্যায়ক্রমে। সপ্তম আসমানের “লওহে মাহফুজ” থেকে ধীরে ধীরে এর প্রকাশ হয় নাই কখনো। তবে নবীজির মৃত্যুর কয়েক বছর পর থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যেগ ও প্রচেষ্টায় কোরআন সংগৃহীত হয়েছে এবং পরবর্ত্তীতে তা গ্রন্থকারে প্রকাশ পেয়েছে প্রায় ২১ বছর পর, হযরত ওসমান (রাঃ) এর শাসনামলে।

তবে এতে সূরা নাজিলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয় নাই অর্থাৎ আগে নাজিলকৃত সূরা পরে এবং পরে নাজিলকৃত সূরাগুলি আগে সংযোজিত হয়েছে। এমনকি একই সময়ে নাজিলকৃত আয়াত বিচ্ছিন্ন করে দু’টি ভিন্নস্থানে সংযোজিত করা হয়েছে। কেনো এরূপ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা আজো অজ্ঞাত। হযরত ওসমান তিন সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করেন কোরআন সংকলনের জন্যে। সেই বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সংগৃহীত ও সংকলিত হয় আমাদের আজকের কোরআন শরীফ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হযরত আলী (রাঃ) এবং আসহাবে সুফফার সকল সাহাবী তখন জীবিত ছিলেন যারা হাফেজে কোরআন ছিলেন। কিন্তু তাদেরকে কেন কোরআন সংকলন বোর্ডের অন্তর্ভূক্ত করা হয় নাই তা রহস্যপূর্ণ। হযরত আলী (রাঃ) অবশ্য একবার ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, “ইহা তো মূক (মৃত) কোরআন।” আমিই তো জীবিত কোরআন (সত্য বল, সুপথে চল, মনজুরুল হক রচিত, পৃষ্ঠা ৩৬- ৩৭, বোদেলা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত)।  

ওসমানের এই কোরআন সংকলনে অনেক বিভ্রান্তিকর আয়াতের সংযোজন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— “গাদীর খুমে” অবতীর্ণ ১ম আয়াতটি কোরআনের সূরা মায়িদা-র ৬৭ নং আয়াত হিসেবে স্থান পেলেও একই স্থানে অবতীর্ণ কোরআনের সর্বশেষ আয়াতটি তার পাশাপাশি না রেখে সূরা মায়িদা-র প্রথম দিকে ৩নং আয়াতের সঙ্গে মধ্যবর্ত্তী একটি হিসেবে নিন্মোক্ত রূপে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।

এ ধরনের অসংলগ্নতা অনেক সূরাতেই পাওয়া যায়, অর্থাৎ এই কোরআনের আয়াতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয় নাই। কেন করা হয় নাই তা আজো প্রশ্নবিদ্ধ।

উল্লেখ্য যে, আজকে যে কোরআনটি আমাদের হাতে রয়েছে তার পূর্বেও রচিত হয়েছিল আরেকটি কোরআন শরীফ। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) এর প্রচেষ্টায় কোরআন শরীফের প্রথম সংকলন মানুষের হাতে আসে। বস্তুতঃ হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত ওমর (রাঃ) দু’জনাই ছিলেন কোরআন এ হাফেজ এবং তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় কোরআন পায় বাস্তব রূপ।

দুর্ভাগ্যবশতঃ তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমানের (রাঃ) হস্তগত হলে তিনি তা আগুনে প্রজ্জ্বলিত করেন। সেইসাথে তার (ওসমানের) নিজের সংগৃহীত কোরআনটি প্রতিষ্ঠিত করেন অভিন্ন এক দলিল হিসেবে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় বা তার মৃত্যুর বহুকাল পর্যন্ত ছিলনা কোরআনের কোন অস্তিত্ব। তার মৃত্যুর পরপরই অনেকে ইসলামের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ফলে তাদের “মুরতা” আখ্যা দিয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) কে তরবারী তুলে নিতে হয় যুদ্ধের জন্য। ইতিমধ্যে স্বঘোষিত “নবী” মুসাইলামা নিজেকে নবী দাবী করে বসেন। ফলে আবু বকর (রাঃ) যুদ্ধে লিপ্ত হন এইসব মুরতাদ দমনে। তৃতীয় দফা যুদ্ধে অবশেষে তিনি ইয়ামামা (বর্তমানে সৌদি আরব, মধ্য এশিয়া) ময়দানে মুসাইলামাকে (স্বঘোষিত নবী) হত্যা করতঃ যুদ্ধে জয়লাভ করেন। খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদ ছিলেন আবু বকরের পক্ষে এই যুদ্ধের পরিচালনাকারী (রজবের শেষ দিকে ১১ হিজরীতে সংঘটিত হয় এই যুদ্ধ)।

এই যুদ্ধের পর আবু বকর (রাঃ) উপলদ্ধি করেন কোরআন সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা। ইতিপূর্বে যদিও হযরত ওমর (রাঃ) তাকে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিন্তু তাতে তিনি সংগত কারণে রাজী হন নাই। তার অভিমত ছিলো যে, নবীজি তাদের এ বিষয়ে কোন নির্দেশ দিয়ে যান নাই কিংবা নিজেও তিনি কোন পদক্ষেপ রাখেন নাই কোরআন সংকলনের ব্যাপারে। অবশেষে, ইয়ামামা যুদ্ধের পর তিনি ওমর (রাঃ) এর কথায় একমত হন ও অনুপ্রাণিত হন কোরআন সংগ্রহ করার।

আমাদের অনেকেই ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি যে কোরআন সপ্ত আসমানের লওহো মাহফুজে সংরক্ষিত ছিলো সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে তা নবীজির কাছে প্রকাশিত হয় জিবরাইল কর্তৃক। কিন্তু তার কোন অস্তিত্ব নেই ইতিহাসের পাতায়। শুধুমাত্র মানুষের শোনা কথায়, মুখে মুখে তা বিস্তার লাভ করেছে এক প্রাচীন উপাখ্যানের অবয়বে। যদি লওহে মাহফুজ থেকে তা নেমে আসতো তাহলে সেটা আর সংগ্রহের প্রয়োজন হতো না। অথচ আমরা জানি হযরত ওমর (রাঃ) ও আবু বকর (রাঃ) তা সংগ্রহের দায়িত্ব দেন যায়দ ইবনে তাহবিদ-কে।  

কোরআনের প্রথম সংকলনঃ

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মৃত্যুর ছয়মাস পর হযরত আলী (রাঃ) প্রথম কোরআন সংকলন করেন যা শিয়া সম্প্রদায় আজো মনে করে থাকে তা ওসমান (রাঃ) এর কোরআনের চেয়ে সঠিকভাবে সংকলিত। কতিপয় শিয়া মনীষী (তফসীরকারক) বিশ্বাস করেন যে, সেই সংকলনটি তৎকালীন মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পায় নাই। অথচ হযরত আলী (রাঃ) এর দাবী ছিলো সেখানে একটি আলিফও লক্ষ্যচ্যূত হয় নাই। শিয়া শাস্ত্র বিশেষজ্ঞ আবু আল কাসিম আল খোয়েই স্বীকার করেছেন যে, হযরত আলী (রাঃ) এর সংকলন ওসমান (রাঃ) এর সংকলনের মাঝে বিরাট ব্যবধান করেছে। ওসমানের সংকলনে অনেক কিছুই সংযোজিত হয় নাই।

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর সংগৃহীত কোরআনঃ

হযরত আবু বকর (রাঃ) খেলাফতকালীন সময়ে (৬৩২- ৬৩৪ হিজরী) হযরত ওমর (রাঃ) যিনি খেলাফতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন (৬৩৪ হিজরী), উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন কোরআনের বিষয়ে। কারণ, যারা কোরআনে হাফেজ ছিলেন তারা অনেকেই ইতিমধ্যে ইয়ামামা যুদ্ধে মারা যান। এই যুদ্ধে প্রায় পাঁচশত কোরআনে হাফেজ মারা যান। কেউ কেউ বলেন যে, এই যুদ্ধে প্রায় সাতশত কোরআনে হাফেজ মারা গিয়েছেন। ভবিষ্যতে কোরআনের অস্তিত্বের প্রশ্নে তাই কোরআন সংগ্রহ করাটা অত্যান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। অতএব আবু বকরের অনুমতিক্রমে ওমর (রাঃ) এ কাজের দায়িত্ব দিলেন যায়দ ইবনে তাহবিদকে। যায়দ ছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একজন কনিষ্ঠ সহকারী যিনি তাঁর নির্দেশ পালন করতেন। এ কাজের দায়িত্ব পেয়ে যায়দ প্যাপিরাসের টুকরা, মসৃন পাথর, খেজুর পাতা, পশুর চামড়া, কাঠ ইত্যাদি থেকে অল্প অল্প করে কোরআন সংগ্রহ শুরু করেন।

কাজটি সম্পূর্ণ হওয়ার পর তিনি তা হযরত আবু বকর (রাঃ) কে দেন। আবু বকরের মৃত্যুর পর তা ওমরের হাতে আসে। পরবর্ত্তীতে, ওমরের মৃত্যুর পর তা ওমরের মেয়ে, নবীজির স্ত্রী হাফসা-র হস্তগত হয় (সূত্রঃ উলুমুল কোরআন ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০২- ১০৭, ডাঃ শফিউল্লাহ, প্রফেসর ইসলামীক ষ্টাডিস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় মুহাজিরগণের মধ্যে যারা কোরআনে হাফেজ ছিলেন তাদের মধ্যে চার খলিফা ছাড়াও হযরত তালহা (রাঃ), হযরত সা’দ (রাঃ), হযরত মাসউদ (রাঃ), হুযায়ফা (রাঃ), হযরত সালিম (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), হযরত ইবনে ওমর (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ), হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে যুবাইর (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুস সাইব (রাঃ), হযরত আয়েশা (রাঃ), হযরত হাফসা (রাঃ) এবং উম্মে সালমা (রাঃ) অন্যতম।

হযরত ওসমান (রাঃ) এর সংগৃহীত কোরআনঃ

হযরত ওসমান (রাঃ) তার কোরআন সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় হাত দেন (৬৪৪- ৬৫৬ হিজরী সনে)। তার এক সেনাপতি তাকে অনুরোধ করেন কাজটি করতে। কারণ, সে সময়ে বিভিন্ন শহরে সেনাদের মধ্যে সঠিকভাবে কোরআন পাঠ নিয়ে বেশ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। এ ব্যাপারে ওসমান তাৎক্ষনিকভাবে যায়দ বিন তাহবিদ কে দায়িত্ব দেন কাজটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাধান করার। যায়দ তিনজনের একটি দল গঠন করে শুরু করেন কোরআনের আয়াতসমূহ একত্রিত করার।

এসময়ে তারা ওমরের কন্যা হযরত হাফসা (রাঃ) এর কোরআনটিও পর্যবেক্ষণ করে দেখেন এবং পরবর্ত্তীতে কুরাইশদের কাছে গিয়ে তাদের আঞ্চলিক ভাষায় লেখা খন্ড খন্ড কোরআনের আয়াতসমূহ সংগ্রহ করেন।

তাদের এ কাজটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়েছিল প্রায় ৬৫০ হিজরীতে। এরপর তারা তা কুফা, বসরা, দামাস্কাস, মক্কা এবং স্বম্ভবত মদিনাতেও প্রেরণ করেন। কোরআনের এই সংস্করণটি বেশ সমালোচিত হয়। কারণ, কোরআন আরবীতে নাজিল হয়েছিল। কোন আঞ্চলিক ভাষায় নয়। অধিকন্তু, এতে অন্যান্য কোরআনের সংস্করণ থেকে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। কোন কোন লোকের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যারা ওসমানের শত্রু ছিল। এদের কেউ কেউ ব্যাপারটি পরিসমাপ্তির আগেই মারা গিয়েছেন।

যদিও ওসমানের এই সংস্করণটি অনেক সমালোচিত হয়েছে এবং আবু বকরের সংস্করণের সাথে বিশাল ভিন্নতা রয়েছে  তবুও, তা সংরক্ষণ করে অন্যান্য সংস্করণগুলো ওসমানের নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এই পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ ওসমান কোথায় পেলেন সেটাই বড় প্রশ্ন। নিশ্চয় তিনি আল্লাহর নির্দেশে তা করেন নাই। তবে তার কোরআন সংকলনের ব্যাপারে ওসমান নিজেই বলেছেন—  তোমরা কেউ বল না যে আমি কোরআনের সবটুকু সংগ্রহ করতে পেরেছি। কারণ কোরআনের বেশীর ভাগ অংশই হারিয়ে গেছে। আমি সংগ্রহ করেছি যা পেয়েছি (আল্লামা আস সূয়ুতির আল ইতকান ফিল উলুমূল কোরআন, ৩ খন্ড ৭২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

নবীজির কনিষ্ঠ স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) বলেছেন— নবীজির সময়কালেই আল-আহযাব এ দুইশত আয়াত ছিল। কিন্তু ওসমান তা কেটে ছেঁটে ৭৩ আয়াতে লিপিবদ্ধ করেছেন। আস-সূয়ুতি আরো বলেন, উবা ইবন কা’ব যিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর সহকর্মী ছিলেন তিনিও বলেছেন সূরা আহযাব এ ২৮৬ টি আয়াত ছিল এবং তা ছিল সূরা বাকারার সমতুল্য। এই বক্তব্যের অবতারণা হয়েছে ইবন হাজম এ (৮ম খন্ড ২য় অংশ, ২৩৪- ২৩৫ দ্র্ষ্টব্য)। তিনি বলেছেন— আলী ইবন তালিবের বর্ণনায় এটা একটা সততার শিকলেন উপর নির্ভর করে (আল মাওলা ৮ খন্ড দ্রষ্টব্য)। জামাক সারি তার বই “আল- কাস সাফ” এর ৩য় অংশ, ৫১৮ পৃষ্ঠায় তা উল্লেখ করেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর পর ৬৩২ হিজরীতে তার অনেক অনুসারী চেষ্টা করেছেন কোরআনের আয়াতসমূহ একত্রিত করার। ইবন মাসুদ, ইবন কা’ব, আবু বকর (রাঃ), আসওয়াদ সহ অন্যান্যরা চেষ্টা করেছেন এগুলো বিশেষভাবে সংগ্রহ করে নিজের নেতৃত্বে কোরআনটি বিশেষভাবে সংরক্ষণ করতে যাতে তা বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে। তবে এতে তারা কঠিন সমালোচনার সম্মুখীন হন। অনেকে মনে করেন ইবন মাসুদের সংগ্রহের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে কারণ নবীজির জীবদ্দশায় তিনি মাসুদের স্মরণ শক্তির উপর নির্ভর করতেন সবচেয়ে বেশী।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ওসমান আবু বকরের সংগ্রহ অগ্রাহ্য করে নিজের সংগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েছেন কারণ, ওসমানের সংগ্রহ সমূহ আবু বকর (রাঃ) এর শত্রুদের দ্বারা সংগৃহীত হয়েছে যারা ছিলো প্রকৃতপক্ষে ওসমানের বন্ধু। এছাড়াও, এতে রাজনৈতিক বিবেচনার বিষয়টির প্রভাব রয়েছে সর্বাধিক।

এখানে উল্লোখ্য যে, কুরাইশ বংশের সাথে উমাইয়া গোত্রের (বংশের) বিরোধ ছিল সব সময়েই। তাদের মধ্যেকার শীতল যুদ্ধের কারণে যুগে যুগে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের অস্ত্রের ঝংকার গর্জে উঠেছে বারে বারে।

প্রশ্ন হলো যদি আবু বকরের সংগৃহীত কোরআনটি অগ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে তাহলে তা কিভাবে ওমরের কাছে বা হাফসার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো? উপরোক্ত অন্যান্য সংগ্রহ সমূহ যা সে অঞ্চলে ভাসমান ছিল তাদের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা আজো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কে কবে কোন্‌ সূত্র থেকে কোরআনের আয়াত সংগ্রহ করে কার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে তা আজ অবধি বোঝা দুষ্কর।

ওসমান তার কোরআন সংকলনের কারণেই বৃদ্ধ বয়সে কতিপয় নবীন মুসলমান তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এমনকি তারা তার দাড়ি টেনে ছিঁড়ে ফেলেন রাগ আর ক্ষোভের তাড়নায়। শুধু তাই নয়, তাকে (ওসমান রাঃ) হত্যা করে টুকরো টুকরো করা হয় দেহকে। কেউ তার জানাযায় দাঁড়ায় নাই কিংবা দুইদিন তার লাশ দাফন না করে ফেলে রাখা হয়েছিল। মুসলমানদের কবরে তার স্থান না হওয়ায় তার চারজন বন্ধু বস্তায় ভরে তার লাশটি অনেক দূরে রাতের অন্ধকারে এক ইয়াহুদীদের কবরস্থানে দাফন করেন। খবরটি মূহুর্তে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পরবর্ত্তীতে, ফিরে আসা সেই চারজন বন্ধুকে প্রস্তর মেরে হত্যা করা হয় নির্দ্ধিধায়। কোরআন পোড়ানো ও নতুন সংকলনের ইতিহাস এভাবেই এগিয়ে চলে এক অজানা অন্ধকারে। আর সেই ইতিহাসের বক্র পথে চলে আমরাও আজ অনেকের প্রাণ সংহার করে চলেছি ইসলামের নামে, কোরআন প্রতিষ্ঠার দাবীতে (আল-তাবারির The History of Nations and Kings দ্রষ্টব্য)।

হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পুত্র আবদুল্লাহ ছিলেন একজন বদরাগী ও অযোগ্য ব্যক্তি। তিনি হযরত আলীকে অপমান করেছেন অনেকবার। এমনকি তাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে এসেছেন (ওমরের সহায়তায়) আবু বকরের আহলে বায়েত গ্রহণের উপস্থিতির মাঝে। তিনিও ছিলেন ওসমানের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত।

হযরত ওসমান তৃতীয় খলিফা হিসেবে ১১ বছর ১১ মাস ১৯ দিন শাসন করেছেন। তার উপাধি ছিল “জুব ‍নুরেইন” অর্থাৎ দুইটি আলোর মানুষ। কারণ, তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) দুই মেয়েকে বিয়ে করেছেন।

ঐতিহাসিক তথ্য মতে, তার বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। তিনি সবার মতামতকে উপেক্ষা করে নিজ সন্তান ওয়ালিদ বিন উকবা-কে কুফার শাসনকর্তারূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। জানা যায়, উকবা মাতাল অবস্থায় নামাযে দাঁড়াতেন। মুহাম্মদ (সাঃ) ওসমানের সন্তানদের মৃত্যুদন্ড সাজা দিয়ে মক্কা ও মদিনাতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। অথচ ওসমান তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজ দায়িত্বে।

মুয়াবিয়া (পঞ্চম খলিফা) তার অধম পুত্র ইয়াজিদের হাতে ক্ষমতা শুধু তুলেই দেন নাই বরং তার হাতে ইমাম হাসান ও হোসেনের বংশকে নির্মূল করে আত্নতৃপ্তি লাভ করেছেন। এহেন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

যে কোন বিচক্ষণ ব্যক্তির অন্তরে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, এইসব বিভিন্ন সংরক্ষণ, সংগ্রহ ও সংকলনকৃত আয়াতগুলি যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত হয়েছে তা কি আল্লাহ্‌ তায়ালার প্রকৃত আয়াত? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে তা কিন্ঞ্চিত গ্রহণ বা প্রত্যাখান করাটা কোনটি আল্লাহর কাছ থেকে আসা এবং তা কিভাবে বিচার করা সম্ভব হয়েছে? কোন্‌ অযুহাতে আবু বকর ও ওমরের সংগ্রহটি বাতিল করা হয়েছে? আর বাতিল করা হলে তা পোড়ানোর নির্দেশটি কি “লওহে মাহফুজ” থেকে এসেছে?

ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী আরবে বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্ঠি তাদের স্ব স্ব রচনা-রীতি অনুযায়ী কোরআন তেলওয়াতে অভ্যস্ত ছিল। এর কারণে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন স্বরে বা উচ্চারণে কোরআন তেলওয়াতের মধ্য দিয়ে কিছু বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। অতঃপর প্রবীণ নেতৃবর্গের হস্তক্ষেপ ও সিদ্ধান্তে কোরআনের স্বরচিহ্নযুক্ত তেলওয়াত গ্রহণযোগ্যতা পায়। তবে খলিফা ওসমান তার কোরআনের একটি বাচন রীতিতে সংকলন করিয়ে নিয়ে অন্যসব প্রচলিত কপিগুলি আগ্নিদ্বগ্ধ করেছেন। এ ঘটনার ফলে তৎকালীন মুসলমানদের অন্তরে খলিফার প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের যে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল তা অপসারণের জন্য বণী উমাইয়া গোত্র (ওসমান ছিলেন উমাইয়া বংশদ্ভুত) তাদের নিহত খলিফার সমর্থনে (ওসমানের মৃত্যুর পর) এ অপ্রচার শুরু করেছিল যে, মুসলমানরা তাকে যতই নিন্দা করুক না কেন, ইসলামী উম্মার উপর তার এমন এক অবদান রয়েছে যা কেয়ামত পর্যন্ত কেউ ভুলতে পারবে না। আর তা হলো— তিনি বিক্ষিপ্ত আয়াত সমূহ সংগ্রহ করে একটি গ্রন্থে রূপদান করে গেছেন।

এই অপ-প্রচারকে শ্যামের (সিরিয়ার) প্রচার যন্ত্রের সাহায্যে এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যে, হযরত ওসমান কোরআন সংকলক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং সেহাহ্‌ মসনদ সমূহ প্রভৃতির যেসব রেওয়ায়েতে প্রথম বা দ্বিতীয় খলিফার আমলে কোরআন সংকলনের কথা উল্লেখ ছিল, সেসব ক্রমান্বয়ে অসার হয়ে গিয়েছে।

এর ফলে ওসমানের বিরোধীগণ ক্ষেভে-দুঃখে ও আবেগে ভেসে এ বিষয়ে আর উচ্চবাক্য করা পরিহার করলেন। পরিণতিতে, তারা এ কথা প্রচারে তৎপর হলেন যে, যেহেতু ওসমান কোরআন সংকলন ও সংস্করণ করেছেন সেহেতু এত চরম অসংলগ্নতা, ধারাবাহিকতা বিবর্জিত ও শৃংখলহীনতা পরিলক্ষিত হয়। তারা একথাও বলেছেন যে, ওসমান যে কাজে হস্তক্ষেপ করেছেন তা সম্পাদন করার যোগ্যতা তার কখনোই ছিল না। ওসমানের এই কার্য প্রয়াসে বণী উমাইয়াদের ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব চরিতার্থ হয়ে গেল। এ ব্যাপারে ইসলামী উম্মার সামনে দু’টি মাত্র পথ খোলা থাকলো। প্রথমতঃ যদি ওসমানকে কোরআন সংকলক হিসেবে তারা স্বীকৃতি প্রদান করে ও কোরআনের সঠিকতা ও সংকলনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তবে তারা উমাইয়া শাসকদের নিকট কৃতজ্ঞবদ্ধ হয়ে থাকবে।

দ্বিতীয়তঃ যদি তারা কোরআনকে অসংলগ্ন, অসংযত এবং বিশ্বংখল হিসেবে স্বীকারোক্তি দেয়, তবে এর অর্থ দাঁড়াবে ইসলামী ইলাহী কানুন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়া। পক্ষান্তরে, এটাও ছিল বণী উমাইয়াদের একটি সুদক্ষ কৌশল ও উদ্দেশ্য।

এছাড়াও, কোরআন সংকলনের ব্যাপারে জোরদার প্রচারণার পেছনে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল বণী উমাইয়াদের। প্রথমতঃ হযরত ওসমানের কোরআন পোড়ানোর অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়া এবং দ্বিতীয়তঃ উম্মাকে এ বিষয়ে আস্বস্ত করানো যে, তিনি অবশিষ্ট কোরআন সমূহ যদি আগ্নিদাহ না করতেন তাহলে ইসলামী উম্মার মধ্যে সঠিক-বেঠিক কোরআন নিয়ে প্রবল হাঙ্গামা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো।

তবে বিশিষ্টজনদের অভিমত অনুযায়ী কোরআনকে এক বচন রীতি রূপদান করা এবং বিক্ষিপ্ত আয়াত সমূহকে সুসংকলন ও সুবিন্যস্ত করা কোন মতেই এক পর্যায়ের কর্ম হিসেবে গণ্য করা যায় না। আর এই এক বচন রীতির কোরআনকে প্রচলিত করার জন্য অবশিষ্ট কোরআনসমূহ পুড়িয়ে ফেলতে হবে তা কোন প্রজ্ঞাবান পন্থা নয়। বরং এর চেয়েও সম্মানজনক পন্থা শরীয়তে বিদ্যমান। এছাড়াও ইসলামী উম্মাকে এ বিষয়ে অবহিত করা বা বিশ্বাসভাজন করানো যে, ইসলামী দপ্তর তথা ইলাহী কালামের সংকলন এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে আহলে বায়েতে বিশেষত হযরত আলী (রাঃ) এর কোন অবদান নেই। ফলশ্রুতিতে, তারা যেন জন মানসে গুরুত্বহীন হয়ে ‍পড়েন এ কারণেই মুয়াবিয়া ও অন্যান্য উমাইয়া শাসক প্রকাশ্যে আহলে বায়েতের প্রতি বারংবার বিদ্বেষমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন অথচ ইসলামী উম্মাহ্‌ তার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করেছেন।

ইবনে ইসহাকের “সিরাতুন নবী” গ্রন্থে এহেন অনেক ঘটনার প্রান্জ্ঞল বর্ণনা রয়েছে।

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৬৩২ হিজরীতে মার যান। তার জীবনী গ্রন্থ প্রথম লিপিবদ্ধ করা হয় তার মৃত্যুর একশত বিশ বছর পর ইবনে ইসহাকের ‘সিরাতুন- নবী’ গ্রন্থে। এরপর তার মূল গ্রন্থটি হারিয়ে যাবার অজুহাতে তার ছাত্র ইবনে হিশাম প্রায় দুইশত বছর পর তা আবার লিপিবদ্ধ করেন অত্যান্ত সংক্ষিপ্ত আকারে। বিশেষজ্ঞদের মতে ইসহাকের লেখায় আহলে কিতাবীদের বিষয়ে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার কারণে তো কৌশলে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পরবর্ত্তীতে তা হারিয়ে যাবার অজুহাতে পুনরায় ইবনে হিশাম দ্বারা গ্রন্থায়িত হয়। ইবনে হিশাম তার ওস্তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সযত্নে পাশ কাটিয়ে গেছেন।

হযরত আলী (রাঃ) সংগৃহীত কোরআনঃ

হযরত আলী (রাঃ) নিজে একজন কোরআনে হাফেজ ছিলেন। তার সংগৃহীত কোরআন বা মুসহাফে ফাতেমা, বর্তমান কোরআনের ‍দ্বিগুণের চেয়েও বড়। তাতে বলা হয়েছে— আল্লাহর কসম তোমাদের এ কোরআনের একটি অক্ষরও এর মধ্যে নাই (উসূলে কাফী, পৃষ্ঠা ১৪৬ দ্রষ্টব্য)। শিয়া মতাবলম্বীরা আজো তা বিশ্বাস ও অনুসরণ করে চলেছে। তাদের মতে বর্তমান কোরআন বিকৃত এবং এটি দলিলের ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য। (সূত্রঃ উসূলে কাফী, পৃষ্ঠা ২৬১, ২৬৬ দ্রষ্টব্য)।

ওসমান সংকলিত কোরআন তারা গ্রহণ করা দূরে থাকুক তা স্বীকৃতিও দেয় নাই। তারা (শিয়া সম্প্রদায়) বলে থাকেন আসলে কোরআন ৯০ পারা, ৩০ পারা নয়। এ কোরআন হযরত আলী নিজ হাতে লিখেছেন। এছাড়াও বলা হয়ে থাকে এ কোরআন ৭০ গজ লম্বা এবং এটা পুরু মোটা উটের রান এর মতো। এ কোরআনের আয়াত সংখ্যা ৭০ হাজার। আর এই কোরআন অনুসারীদের বক্তব্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মৃত্যুর সময় এক লক্ষ চব্বিশ হাজার সাহাবী ছাড়া সকলেই মুরতাদ তথা ইসলাম ধর্ম ত্যাগকারী, গোর্সরাহ ও পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন (সূত্রঃ তানবীহুল মো’মেনীন, মুহাম্মদ আজিজুল হক আল্‌ কাদরী রচিত, পৃষ্ঠা ১৮, ১৯ দ্রষ্টব্য)।

হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রাঃ) ছিলেন ইসলামে চতুর্থ খলিফা ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর চাচাতো ভাই ও জামাই। তিনি চার বছর সাত মাস শাসন করেন। তার শাসনামলে তিনি তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করেন একের পর এক। নবীজির সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী আয়েশা (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ) এবং জুবাইর (রাঃ) বিরুদ্ধে তিনি “উষ্টের যুদ্ধে” অংশ নেন। এছাড়াও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে “সিফিনের যুদ্ধে” অংশ নেন তিনি। তার শাসনামলে তিনি অনেক বিরুদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এক পর্যায়ে আবদ আল রাহমান এর হাতে বৃদ্ধ বয়সে সেজদায় থাকা অবস্থায় নিহত হন। তাকে আততায়ীর হাতে নিঃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।   

ওসমানের (রাঃ) সংগৃহীত কোরআনঃ

ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী হযরত ওসমান (রাঃ) কোরআন সংগ্রহ ও সংকলনে হাত দেন তার খেলাফতকালীন সময়ে (৬৬৪-৬৫৬ হিজরী)। খলিফা ওসমান যায়দ ইবন তাহবিদ কে ‍দায়িত্ব দেন কোরআন সংকলন ও সংগ্রহের। যায়দ তার তিনজন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে কোরআন সংগ্রহের কাজে হাত দেন এবং তা স্বম্ভবত ৬৫০ হিজরীতে সম্পন্ন করেন। ওসমান তাৎক্ষণিকভাবে এর কপিসমূহ কুফা, বসরা, দামেস্ক এবং মক্কা-মদিনাতেও প্রেরণ করেন। সেই সাথে পূর্বের সংগ্রহকৃত (হযরত আবু বকরের সময়কালীন সময়ে) সবগুলি কপি আগুনে পোড়ানোর নির্দেশ দেন। এখানে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, ওসমান (রাঃ) ছিলেন ওমাইয়া বংশদ্ভূত। তার ঘনিষ্ট আত্নীয় ছিলেন হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) যিনি হযরত আলী-র মৃত্যুর পর খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন অনেকটা শক্তির জোরেই। ওসমান তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে নিজের নিকটতম আত্নীয়স্বজনকে ব্যবহার করেছেন সর্বাধিক। আলী (রাঃ) এর মৃত্যুর পরপরই খেলাফতের সর্বাধিক দায়িত্ব চলে যায় উমাইয়া বংশের হাতে। তারা ৭২ বছর নিজেদের শাসন ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ করেছেন ইসলামের রাজত্ব।

বলা হয়ে থাকে যে, ওসমানের সংকলিত কোরআন অনেক সমালোচনায় দুষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওসমানের কোরআন শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের দোষে দুষ্ট তা নয়, এতে প্রকাশ পায় আবু বকর (রাঃ) এর সৃষ্ট অনেক গল্পের সমাহার। এছাড়াও, আবু বকরের শেষ সংকলনটি যা হাফসা (রাঃ) (হযরত মুহাম্মদ সাঃ -র  স্ত্রী ও ওমর কন্যা) এর সংগ্রহে ছিল, তাও ওসমান কৌশলে চেয়ে নিয়েছেন এবং আগুনে নসাৎ করেছেন নিজ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে।

ওসমানের নিজ পুত্র সর্বপ্রথমে তার সমালোচনা করেন কোরআন নতুনভাবে সংকলন করার জন্যে।

আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, আজকের কোরআন তাদের হাতে এসেছে হযরত ওসমানের কর্ম প্রয়াসে। মুসলিম গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসীরা (Orthodox Muslim) বলেন যে, ওসমানের এই কোরআনে আল্লাহর সব প্রত্যাদেশগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ধরনের লোকেরা তাদের বিশ্বাস স্থাপন করেন শুধুমাত্র স্বমত পোষক উপাদানগুলিতে। কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন বা প্রমাণের ভিত্তি নাই। অথচ প্রাচীনকালের ইসলাম বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে অত্যান্ত নমনীয়। কারণ, তারা জানেন যে, ওসমানের এই ধরনের বিভিন্ন অংশের বিবরণ, আয়াত হারিয়ে যাওয়া ও নতুন আয়াতের সংযোজন করাটা সত্যভ্রষ্টতার দোষে দূষিত হয়েছে।

আল্লামা আস-সূয়ুতি যিনি অত্যান্ত বিখ্যাত কোরআন তাফসীর কারক হিসেবে পরিচিত, বলেন— ওমর আল খাত্তাব বলেছেন-  “কেউ না বলুক যে, সে সমস্ত কোরআন সংগ্রহ করেছে। কারণ, তিনি কিভাবে জানেন যে এটাই সবটুকু কোরআন? বস্তুতঃ কোরআনের অনেক অংশ হারিয়ে গেছে (আস্‌ সূয়ুতির আল ইতকান ফী উলুমুল কোরআন, ৩য় খন্ড, ৭২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

নবীজির সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন— (যা সূয়ুতির লেখায় প্রকাশ পায় যে, মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবদ্দশায় সূরা আহযাব এ দুইশত আয়াত ছিল। কিন্তু যখন ওসমান তা সম্পাদনা করেন তখন তা শুধুমাত্র তেয়াত্তরটি (৭৩) আয়াতে পরিণতি হয়।

আস্‌ সূয়ুতি আরো বলেন— উবা ইবন কা’ব এর ব্যাপারে যিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অত্যান্ত ঘনিষ্টজনদের অন্যতম। এই বিখ্যাত ব্যক্তি একজন বিশষ্ট মুসলিম মনীষীকে জিজ্ঞেস করলেন, সূরা আহযাব এ কতগুলো আয়াত আছে? উত্তরে তিনি বলেছেন, তেষাত্তরটির (৭৩) কথা। অথচ উবা তাঁকে বলেছেন যে, এটা ছিল প্রায় সূরা বাকারার সমান দীর্ঘ (প্রায় ২৮৬ টি আয়াত)।

ইতিহাস লেখক ডঃ মুসা-এল-মূসাউই (Dr.Mosa-El-Mosawy) তার আল সেয়া গ্রন্থের ১৩১ পৃষ্ঠায় বেশ খোলামেলাভাবেই বলেন যে, যারা কোরআনে সত্যভ্রষ্টতার আশ্রয় নিয়েছিলো তারা ইসলামের বিভিন্ন দলের অংশ। তবে তাদের বেশীরভাগ এসেছিল আল সেয়ার মনীষীদের কাছ থেকে।

বস্তুতঃ কোরআনে সত্যভ্রষ্টতার ব্যাপাটি এত বেশী প্রকাশ ঘটেছে যে, সেটা ঢাকতে (ইসলাম বিশেষজ্ঞরা) তৎপর হয়ে উঠেছিলেন যেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ না হয়ে পড়ে। যদিও ডঃ মুসা তা অকপটে স্বীকার করেছেন তবুও শুধুমাত্র তার উপর নির্ভর না করে আমরা আরো কয়েকটি প্রমাণের কথা উল্লেখ করতে পারি। ইতিমধ্যে আমরা ওসমানের নিজের সাক্ষ্য, উবা এবং আয়েশার কথা উল্লেখ করেছি যারা সবাই বলেছেন ওসমানের এই সংকলনের দুষ্টতার কথা। সেই একই ঘটনার অবতারনা দেখা যায় ইবন হাজমের পুস্তক (৮ম খন্ড, অংশ ১১, পৃষ্ঠা ২৩৪, ২৩৫) তে। হযরত জামাকসারী তার লেখা আল কাশ-সাফ পুস্তকেও (৩য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮) একই কথা বলেছেন।

উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে ইতিহাসের পাতায় প্রতিষ্ঠিত। তারা হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন চরিত রচনা করেছেন এবং তাদের লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনেক বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা দান করে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁদের মন্তব্য নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্যতা পাবার মতো। তাহলে প্রশ্ন হলো- ওসমান কেনো আবু বকরের সংগৃহীত কোরআনসমূহ পোড়ালেন? তবে কি তার প্রতি কোরআন পোড়ানোর নির্দেশটি কি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছিল? নাকি তিনি আল্লাহর কালামের বিষয়ে নির্দ্ধিধায় মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে চেয়েছেন? তার কি সেই ক্ষমতা রয়েছে? কে দিলো তাকে এ ক্ষমতা?

পূর্বের কোরআন সমূহ পুড়িয়ে নসাৎ করার কারণে আজকে তা বিশ্লেষণের কোন অবকাশ রইলো না। এমতাবস্থায় এটাই কি প্রতীয়মান হয় না যে, কোরআন কখনো “লওহে মাহফুজ” থেকে অবতরণ করে নাই আমাদের করতলে?

আয়াতের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাঃ

ইবনে হাজম (Ibn Hajam) তার বইয়ের (৮ম খন্ড, ২য় অংশ, পৃষ্ঠা ২৩৫, ২৩৬) এ সহজভাবে বলেছেন যে, যখন মুহাম্মদ (সাঃ) মারা যান এবং তার মৃত দেহ দাফনের কাজে আয়েশা (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) ব্যস্ত ছিলেন, তখন এক গৃহপালিত জন্তু (ছাগল) তার ঘরে (আয়েশার) ঢুকে পড়ে এবং তার সংরক্ষিত কোরআনের বেশ কিছু আয়াত (যা তার বিছানার নীচে ছিল) খেয়ে ফেলে। আয়েশা (রাঃ) নিজেই বলেছেন যে, তার মনে আছে যা তার সংরক্ষণে ছিল। এছাড়াও, মুস্তাফা হোসাইন, যিনি ‘আল-কাশ-সাফ’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন তিনিও বলেছেন একথা। জামাক সারি তার রচিত ‘আল-কাশ-সাফ’ এ উল্লেখ করেছেন (৩য় খন্ডে, ৫১৮ পৃষ্ঠায়)। তিনি বলেছেন এ বিষয়টি আব্দুল্লাহ্‌ ইবন আবু বকর ও আয়েশা (রাঃ) সমভাবে জানতেন।

দরুল কুতনী-র ‘আল-বাজার’ এ এবং তাবারীণীতে ও এই ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। ইবনে ইসহাক একথা জেনেছেন আবদুল্লাহর কাছ থেকে যিনি তা জেনেছেন আয়েশা (রাঃ) এর কাছ থেকে।

আরো বেশ কিছু আয়াত রয়েছে যা লিপিবদ্ধ করা হয় নাইঃ

আস্‌ সূয়ুতি তার ইতকান পুস্তকের (৩য় খন্ডে, ৭৩ পৃষ্ঠায়) আবু ইউনুসের কন্যা হাসিদার তথ্য দিয়ে বলেছেন, যখন আমার বাবার বয়স ছিল আশি বছর, তখন তিনি আয়েশা (রাঃ) এর অনুলীপি পড়ছিলেন, আল্লাহ্‌ এবং তাঁর ফেরেশতারা (তার জন্য প্রার্থনা করেন) নবীর জন্য রহমত প্রার্থনা করছিলেন। তোমরা যারা বিশ্বাস কর, তার জন্য রহমত প্রার্থনা কর।

হামিদা বলেন, এটা ছিল ওসমানের কোরআনের আয়াত পরিবর্তনের আগের ঘটনা। ৭৪ পৃষ্ঠায় আমরা দেখতে পাই, আব্দুর রহমান ওয়াফকে ওমর বলেন, ‘তুমি কি আয়াতসমূহের মধ্যে ওই আয়াতটি পাওনাই যা আমরা পেয়েছি?’ সেখানে বলা হয়েছে “পরিশ্রম কর যেভাবে তুমি ইতিপূর্বে করেছো।” আমরা এই আয়াতটি আর খুঁজে পাই নাই। আব্দুর রহমান ইবনে ওয়াফ তাকে বলেন, এই আয়াতগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে কোরআন থেকে। আব্দুর রহমান ইবনে ওয়াফ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি যিনি খলীফার জন্য মনোনীত হয়েছিলেন।

একই পুস্তকের একই পৃষ্ঠায় আমরা দেখি যে, মাসলামা বলেন— আমাকে দুইটি সঠিক আয়াত দেখাও যা ওসমান সংগৃহীত কোরআনে স্থান পেয়েছে। তারা তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মাসলামা বলেন— তোমরা যারা ঈমান এনেছো এবং হিজরত করেছো এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছো নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, এমনকি নিজেদের সম্পত্তি ত্যাগ করেছো তারা অর্জন করেছো সম্মান ও গৌরব; কারণ তোমরা সফলকাম।

এছাড়া যারা তাকে এই কাজে সহায়তা করেছে এবং রক্ষা করেছে তাদের প্রতি আল্লাহর কি বিচার অপেক্ষা করছে তা কেউ জানেনা।

একথা না বললেই নয় যে, আমরা শুধুমাত্র কতিপয় বিশিষ্ট সাহবীদের সাক্ষ্য ও উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরেছি যাদের মর্যাদা ইসলামিক বিশ্বে অত্যান্ত বেশী, বিশেষতঃ কোরআন ও হাদিসের ব্যাপারে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন—হযরত আলী (রাঃ), ওসমান (রাঃ), আবু বকর (রাঃ), আয়েশা (রাঃ), ইবনে মাসুদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ)। কোরআনের বিষয়ে এদের চেয়ে বেশী ব্যাখ্যা কেউ করতে পারে বলে কারো জানা নেই।

এবার ‘আল-ইতকান’এর ১৮৪ পৃষ্ঠায় নজর দেওয়া যাক। এখানে হযরত মালিক (রাঃ) বলেছেন যে, কোরআনের ৯ অধ্যায়ে (তাওবা) থেকে বেশ কিছু আয়াত বাদ দেওয়া হয়েছে। এ কথা বলা হয়েছে কেননা এই সূরাটি বাকারার মতো দীর্ঘ ছিল। তার মানে হলো এই যে, এই সূরা থেকে ১৫৭ টি আয়াত বাদ দেওয়া হয়েছে। সূয়ুতি বলেন যে, এইসব আয়াতসমূহ মাসুদ (রাঃ) এর কাছে ছিল।

হযরত ওসমান তা তার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন এবং অগ্নিদগ্ধ করেছেন বর্তমান কোরআনটি সংকলনের সময়ে। শুধুমাত্র কতিপয় আয়াতই নয় অনেকগুলি আয়াত ওসমান বাতিল করেছেন নিজের কোরআন থেকে। সূয়ুতি এবং অন্যান্য আয়াত বিশারদেরা বলেন যে, ‘খাল’ নামে পরিচিত ছিল তা সূরা ‘আসর’ অধ্যায়ের পরে সন্নিবেশিত হয়েছে। সূয়ুতি ১৮৫ পৃষ্ঠায় বলেন – হযরত আলী (রাঃ)ও জানেন সে কথা। ওমর ইবনে আল্‌ খাত্তাব সেদজায় গিয়ে এই সূরাগুলো পড়তেন। আস্‌ সূয়ুতি এইসব তথ্য তার বইয়ের ১৮৫ পৃষ্ঠায় পরিপূর্ণ পরিসরে প্রকাশ করেছেন। কোন আরবীয় পন্ডিত যদি তা পড়ে দেখতে চান, তা পড়ে দেখতে পারেন।

উপরোক্ত তথ্যানুযায়ী মনে প্রশ্ন জাগতে পারে—তাহলে কোরআনের কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক? এ উত্তরটি পাঠককে নিজেই বিবেচনা করে নির্ধারণ করে নিতে হবে।     

  

This Post Has 2 Comments

Leave a Reply