You are currently viewing আল্লাহর সীমাহীন মহব্বত ও আমাদের বিভ্রান্তি।

আল্লাহর সীমাহীন মহব্বত ও আমাদের বিভ্রান্তি।

  • Post author:
  • Post last modified:May 11, 2021

ল্লাহর সীমাহীন মহব্বত বা ভালবাসার চেয়ে তাঁর শরীয়তী বিধান ও শাস্তির কথা আমাদের আলোচনায় প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। কোন কাজটি করলে গোনাহ্ হতে পারে, কোন্ কাজটি হারাম বা নাজায়েজ সে সববিষয়ে পটু আমাদের আলেম সমাজ। অথচ কখনো তারা বয়ান করেন না যে, আল্লাহ্ রব্বুল আলামিন তাঁর সৃষ্ট মানব সন্তানকে কত ভালবাসেন। যদি তাঁর অন্তরে মানবের জন্য ভালোবাসা নাই থাকতো, তাহলে কেন তিনি তাদের সঠিক পথ নির্দেশ দিলেন? কেনই বা তিনি তাদের কারণে শরীয়তী বিধানসহ নবী-রসুলদের পৃথিবীতে পাঠালেন?

মানুষ যেন বিপথে না যায় কিংবা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গোনাহ্গার না হয় সেজন্যই তাঁর প্রকৃত প্রচেষ্টা। যেন তাঁর মহব্বতের মানুষ তাঁর প্রকৃত রূপ উদ্ঘাটন করে তাঁর সংস্পর্শে আসে প্রতিনিয়ত। এতেই তাঁর মহব্বতের প্রতিফলন ঘটে।  কিন্তু আমাদের আলোচনায় আর ধর্মীয় শিক্ষায় আমরা তাঁর মহব্বতের কথা ভুলেও উল্লেখ করি না।

আল্লাহ্ যেন সর্বদা আমাদের ভয় এর কারণ। আর এই ভয়ের কারণেই তাঁর সাথে আমাদের সৃষ্টি হয় বিশাল দূরত্ব। সু-নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাঁর সামনে নতজানু না হলে যেন সবাইকে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামের আগুনে। অথচ এই তথ্যের ভিত্তিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বরং এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর সাথে দূর্বব্যবহার করি আমরা।

একটু চিন্তা করে দেখুন তো আপনাকে কি তিনি অত্যান্ত রাগের বশবর্ত্তী হয়ে সৃষ্টি করেছেন নাকি মহব্বতের আতিশয্যে? কি মনে হয় আপনার? যদি মহব্বতের আতিশয্যে তিনি আপনাকে –আমাকে সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে কি আমাদের সেই মহব্বতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত নয়?

একজন চিত্রশিল্পী কি কখনো রাগ বা দুঃখের কারণে কোন শিল্পকর্ম করেন? নাকি মনের আনন্দে আর আবেগের উচ্ছাসে তার প্রকাশ ঘটান নিজের শিল্পকর্মে?

প্রতিটি শিল্প আর চিত্রকর্মের প্রতিফলন ঘটে তার সৃষ্টকারী ব্যক্তির মন ও মননের প্রসারতার। আমাদের সৃষ্টিকর্তা যিনি আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকারী, যিনি বেহেস্ত ও দোজখের সৃষ্টিকারী, যিনি আপনাকে-আমাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর অন্তরে আছে মহব্বতের অন্তিম ফোয়ারা। আমরা না জেনে তাঁর শাস্তির চোখ রাঙানো কে ভয় করি, কিন্তু মহব্বতের আলিঙ্গনে আত্মহুতি  দিতে পারি না।

একটি গল্পের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করি। এতে হয়তো তা পরিষ্কার হবে।

লাতিন আমেরিকার একটি দেশের একটি ছোট শহরে বাস করতো পনেরো বছরের মেয়ে তানিয়া। বাবা ছাড়া সংসারে আর কেউ নেই তার। ছোট বয়সে মাকে হারিয়েছে তানিয়া।  তাই বাবাই হলেন তার একমাত্র অবলম্বন ও সঙ্গি। বাবার অনেক কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে স্বচ্ছল তানিয়ার পরিবারটি। কিন্তু সেই বাবা অবশেষে অবসর নিলেন চাকরি থেকে।  সেই সাথে তানিয়ার যেন স্বপ্নভঙ্গ হলো। তার অনেক স্বাদ-আহ্লাদ ছিল বড় হবার, সুখি হবার আর প্রাচুর্যের মাঝে হারিয়ে যাবার।

একদিন সে বাবার অনুমতি চাইলো রাজধানী শহর এ যাবার। সেই সাথে জানালো জীবনকে প্রাচুর্যে উপভোগ করার বাসনা। বাবা বললেন, তুমি মেয়ে মানুষ, আর এই বয়সে কিবা করতে পারো। আমার আশ্রয়ে থাকো, নিরাপদ হবে। আমি সাধ্যমতো তোমার প্রত্যাশা পূরণ করবো।  কিন্তু তবুও, একদিন তানিয়া বাবার অজান্তে ঘর ছেড়ে বিশাল শহরের দিকে পাড়ি জমাল।

বাবা যখন জানলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তানিয়া চলে গেছে বাবাকে শূন্য ঘরে একা রেখে, এক অজানা উদ্দেশে। প্রাচুর্যের স্বপ্নিল প্লাবনের এক ভিন্ন খাতে।

শঙ্কিত বাবা মেয়েকে হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে পড়লেন। কোনো ঠিকানা রেখে যাইনি তানিয়া, স্মৃতিটুকুছাড়া। অনেক মনকষ্টের মাঝেও বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি শহরে যাবেন তানিয়ার খোঁজে।

খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি তাঁর সমস্ত অর্থ একসাথে করে নিকটবর্তী এক স্টুডিওতে গিয়ে নিজের ছবি তুললেন, আর তার হাজার হাজার কপি করলেন। এরপর তিনি একদিন শহরে গিয়ে পৌঁছালেন হারানো মেয়েটার অন্বেষণে। শহরের পথে পথে হাঁটেন বাবা মেয়েটির খোঁজে। কিন্তু এতবড় শহরে কে দিবে তাকে তানিয়ার সন্ধান! তাই প্রতিদিন শহরের পথে পথে তিনি হাঁটেন আর হোটেলে, সরাইখানা, রেস্টুরেন্টের দেয়ালে দেয়ালে নিজের ছবি লাগানোর কাজটি সমাপ্ত করে নিজ শহরে ফিরে গেলেন তানিয়ার বাবা। তাঁর প্রত্যাশা, একদিন না একদিন তানিয়ার চোখে পরবে তাঁর ছবি, আর হয়তো তাঁর কথা মনে পরবে মেয়েটির।

এদিকে একদিন সন্ধ্যায় তানিয়া যখন এক যুবকের হাত ধরে হোটেলে প্রবেশ করছিল, ঠিক তখনই তার চোখে পড়লো দরজায় লাগানো বাবার ছবিটির দিকে। কাছে গিয়ে আরও নিশ্চিত ও আশ্চর্য হল যে, কি ব্যাপার! একটানে ছবিটি দরজা থেকে তুলে হাতে নিল তানিয়া, ছবিটির উল্টো দিকে ছোট কয়েকটি কথা লেখা রয়েছে যা তানিয়াকে আর স্থির রাখতে পারলো না। তাতে লেখা ছিল, “তানিয়া, তুমি যেখানেই গিয়ে থাকো না কেন, আর যাই-ই করে থাকো না কেন, মনে রেখো আমি তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করবো আর প্রত্যাশ্যা করবো আমার কাছে ফিরে আসার। কারণ, আমি যে তোমার বাবা, আমি তোমায় খুব ভালবাসি তানিয়া।”

সেই ছোট্ট বাক্যগুলো পরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো তানিয়া। তার চৈতন্যের উদয় হল আর বুঝতে পারলো কতবড় অন্যায় করেছে সে বাবাকে ত্যাগ করে প্রাচুর্যের পিছনে ছোটার বাসনায়। সিদ্ধান্ত নিলো তৎক্ষণাত ফিরে যাবে সে বাবার কাছে, প্রেমময় পিতার কাছে। এর পরের ঘটনাটি সহজেই অনুনেয়।

কিন্তু অনেকেই তানিয়ার মত ফিরতে পারে না, বুঝতে পারে না আল্লাহর মহব্বতের আহ্বান। তাই শহরের পথে পথে খুঁজে ফেরে জীবনের বৈচিত্রের রূপ অন্বেষণে।

গল্পটিতে বাবার চিত্রটি আল্লাহ্ পাকের চিত্রের মত, আর আমরা হলাম তানিয়ার মতো, যে যার মত চলেছি জীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে। আমাদের সময় নেই মহান আল্লাহর ভালবাসার প্রকৃত রূপ উদ্ঘাটনের, তাঁর কথা শোনার, তাঁর কালাম বিবেচনার সময় নেই আমাদের তাই মনোরঞ্জক কয়েকটি ফতোয়ার বয়ান শুনে সেইমতো শরীয়তী কিংবা মারফতি বিধানে অবরুদ্ধ নন। এই বিশ্বভ্রম্মান্ডের  তিনিই পিতা, তিনিই এর মালিক। তাঁর মহব্বত বুঝতে হলে তাঁর কালামকে অনুসরণ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই।

শরীয়ত অনুযায়ী বা পালনকারী কোন ব্যক্তি কি বুক ফুলিয়ে বলতে পারবেন যে তিনি শরীয়ত ভঙ্গকারী নন? পারবেন না। কারণ এমন কোন শরীয়ত বিষারদ নেই জগতে যিনি কখনো রক্ষা করতে পেরেছেন পুরোপুরিভাবে শরীয়তের বিধিবিধান। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা অনবরত হারিয়ে ফেলি আল্লাহর মহব্বতের প্রশস্ত পরিসর, যখন খুঁজে ফিরি শরীয়তের দীর্ঘ তালিকা। কেননা আল্লাহ্ তায়ালা কোন বিধিবিধানের হাতে বন্দী নন। কোন সুনির্দিষ্ট কর্মকান্ডের পরিধিতেও তিনি পরিতৃপ্ত হন না কখনো।

অথচ কখনো কি আমরা শুনেছি কোন ইসলামী পন্ডিত্বের মুখে আল্লাহর মহব্বতের কথা? আমরা যা শুনে থাকি তা হলো আল্লাহর গজবের কথা, শাস্তির কথা আর সেইমতো কল্পিত সব উপাখ্যান।  তাছাড়া এইসব হুজুরদের মুখে কিভাবে প্রকাশিত হবে আল্লাহর মহব্বতের কথা? যারা নিজেরা কখনো অনুভব করতে পারে না আল্লাহর মহব্বত ও সীমাহীন ভালবাসার কথা, তারা কিভাবে তা বয়ান করবেন?

ছোটবেলা থেকেই মাদ্রাসা-মক্তদের বেত্রাঘাত আর শিকলের বন্ধনে যাদের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা, তারা কিভাবে চিন্তা করতে পারেন আল্লাহর সৃষ্টিশীলতা আর ভালবাসার গুনাগুন? তাদের কাছে আল্লাহ্ তায়ালা যেন নিষ্ঠুর এক জল্লাদ কিংবা জঘন্য এক ব্যক্তি।

সে কারণেই তারা (ইসলামী পীর-ফকির আর মোল্লারা) বরদাস্ত করতে পারেন না ভালবাসা নামক মানুষের সুকমল প্রবৃত্তিটিকে। অতএব, কথায় কথায় জালাও, পোড়াও, কতল করো ছাড়া আর কোন্ শব্দ উচ্চারিত হতে পারে এহেন ব্যক্তিদের ওষ্ঠাধর থেকে? এদের কাছে সাহিত্য-সংস্কৃতি, শিল্পকর্ম আর স্থাপত্যকলা যেন বেহেল্লপনার সামিল। অথচ এটাই আমাদের মননশীলতার অভিব্যক্তি, সৌন্দর্যের প্রতীক।

যে আল্লাহর মহব্বতের কথা বোঝে না সে গজবের কথা বলে, গোনাহের পরিমান ব্যক্ত করে। অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালার অবাধ্য হলে, কিতাবের বিপরীতে অবস্থান নিলে গোনাহ্গার হয়ে তাঁর রোষানলে পড়ার ভয় রয়েছে আমাদের  সবার। কিন্তু আমরা যখন যত্রতত্র তাঁর আদেশ অমান্য করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আতিশয্যে তা থেকে নিজের কলুষিত জীবনকে আড়াল করার চেষ্টা করি তখন কি তিনি বোঝেন না আমাদের ভন্ডামিটুকু?

একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি কিঞ্চিৎ পরিষ্কার হবে। ধরা যাক- আমরা সবাই তো জানি শুকরের মাংস খাওয়া হারাম। একইভাবে মদ-গাঁজা, ঘুষ ইত্যাদি খাওয়াও সমভাবে হারাম। এছাড়াও বেশ্যাবৃত্তি, বচসা করা, মিথ্যা বলা, খুন-জখম করা, বলাৎকার করা বা ধর্ষণ করা, হত্যা করা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি সবগুলি হারাম বলে বিবেচিত। অথচ আমরা শুধুমাত্র শুকরের মাংস বর্জন করে থাকি আর সব (মন্দ) হারাম কাজগুলি নির্দ্ধিধায় করে চলেছি। সেইসাথে বুক ফাটা চিৎকারে বয়ান করে চলেছি “আল্লাহ্ আকবর” আল্লাহ্ মহান।

মহান আল্লাহ্ তায়ালা পরম পবিত্র। তাঁর সীমাহীন মহব্বত ও পবিত্রতায় আমাদের কৃতজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। চিৎকার করলেই যেমন ভাল বক্তা হওয়া যায় না তেমনি মাথায় পাগড়ী জড়ালেই মুসুল্লী হওয়া যায় না। সত্যিকার ঈমানদারদের মন-প্রাণ থাকে আল্লাহর প্রভুত্বের কাছে সমর্পিত। নির্মল চরিত্রের মানুষ তার নিজস্ব ভালবাসার পরিমন্ডলে খুঁজে পায় আল্লাহর সাক্ষাত। আর আল্লাহ্ তায়ালা এমন লোকদেরই খুঁজে চলেছেন যারা তাঁর মহত্বের  অনুসন্ধান করে। সৃষ্টির সব কিছুই আল্লাহর নখদর্পণে, নিয়ন্ত্রণে। অথচ তাকেই বোকা বানাবার পাঁয়তারা করি আমরা সমস্ত অসামাজিক আর নোংড়ামি কর্মকান্ডে। তখন আর কারো মনে উদয় হয়না “হারাম” কথাটির তাৎপর্য।

আল্লাহর মহব্বতের কথাগুলো আমরা বুঝবো কিভাবে? আমরা কি তাঁর কথা মান্য করে চলেছি? মোটেও না। আমরা বরং তাঁকে যেন-তেন প্রকারে জব্দ করি নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির অভিলাষে। আর বয়ান করি তাঁরই নামে মিথ্যার অজস্র সংবাদ। এ যেন মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢাকা দেওয়ার মোক্ষম চর্চা। তাতে বিভ্রান্ত হই আমরা নিজেরাই।

আসুন, আমরা নিজেদের অন্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখি কি আছে সেখানে? যদি সেখানে না থেকে থাকে স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য ও সম্মান, তাহলে আজই তাঁর দিকে ফিরতে পারি আমরা অনুশোচনার অশ্রু নিয়ে। ক্ষমা চেয়ে নিতে পারি তাঁর ভালবাসার মূল্যায়ন না করার।

আপনি কি সত্যিই তাঁকে জানতে চান? তাহলে নিরবে তাঁর কাছে ক্ষমা চান, এখনই। 

আরও জানুন: আল্লাহর বিভাজন: আল্লাহ্ কয়ভাগে বিভক্ত? 

This Post Has One Comment

  1. Kitab

    Love of our Father is beyond comprehension.

Leave a Reply