You are currently viewing আল্লাহর বিভাজন: আল্লাহ্ কয়ভাগে বিভক্ত? (১ম অংশ)

আল্লাহর বিভাজন: আল্লাহ্ কয়ভাগে বিভক্ত? (১ম অংশ)

  • Post author:
  • Post last modified:May 21, 2021

ল্লাহ্ কয় ভাগে বিভক্ত” কথাটি শুনতে খারাপ লাগলেও প্রশ্নটি আত্যান্ত প্রাসঙ্গিক এবং এটি একটি ব্যাখ্যার দাবী রাখে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো কতগুলি বিভেদ আর বৈপরিত্বের দেয়ালে ঘেরা আমাদের ইসলামী জীবন ব্যবস্থা? একদল বলেন মসজিদে মাইকে আযানের ব্যাপারটি শরীয়ত বহির্ভূত আর আরেকটি দল বলে চলেছেন- না, তা বর্তমান যুগে অবধারিত। একটি দল গান-বাজনাকে হারাম হিসেবে গণ্য করেন, অন্য দলটি তা এবাদতের মাধ্যম মনে করেন। এক পীরের ভক্ত অন্য পীরের ভক্তদের কাফের বলে সন্মোধন করতে দ্বিধাবোধ করেন না। 

বস্তুতঃ প্রত্যেকটি ইসলামী দল বা পীর মুরীদের অনুসারীরা অন্য দলটিকে মনে করেন ভ্রান্তিপূর্ণ মুসলমান। তাহলে কি ধরে নিতে হবে আল্লাহ্ বিভক্ত হয়েছেন? যদি তা নাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের মাঝে এতো বিভক্তি কেন? কেন আমরা যে যার মতো নিজস্ব মতভেদের দেয়াল দিয়ে একে অন্যকে বিভেদের বিব্রতায় ফেলেছি? একই ইসলামের ছত্রছায়ায় কেউ শিয়া, কেউ সুন্নী, খারিজী, কাদরীয়া, মুতাজিলা, জাবুরিয়া ছাড়াও রয়েছে ওহাবী, কাদিয়ানী, তাবালিগী, তাবলিগ বিরোধী, দেওবন্দী, ফরায়েজী, আশারিয়া, ইসমাঈলিরা, বাহাই আরো কতই না দলে বিভক্ত হয়েছে ইসলামী বান্দারা। কেউ কেউ বলেন চার মাজহাবের এক মাজহাবের অনুসারী হওয়া বাঞ্চনীয়। আবার কেউ বলেন কোনো মাজহাব মানা যাবেনা ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাই বলেছিলাম কোন্ পথে চলবো আমরা? কোনটিইবা সঠিক পথ?

আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে মানুষ এখন আল্লাহর কথাকথিত ওলীর পেছনে ছুটছে প্রবল উদ্যমে। মুরীদ হয়ে তরিকা না নিলে যেন ঈমানটাই হালকা হয়ে যায়। তাই  বুঝি একে অন্যকে দোষারোপ করার মধ্যে আমরা নিজেদের অবস্থানটিকে পাকাপোক্ত করতে চাই সর্বদা।

এক আল্লাহ্ ও এক নবীর অনুসারী হয়ে কেন তবে এতো মতভেদ? এই মতভেদের পেক্ষিতে দলা-দলি, মারামারি, রক্তপাত করতেও দ্বিধাবোধ করেন না কেউ। ইসলামের চার খলিফার কথাই যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে সেখানেও ছিল সেই একই মতভেদের পাহাড়। এ কারণে চার খলিফাকে একে একে জীবন দিতে হয়েছে মতভেদের রুদ্র হানাহানিতে। হযরত আলী (রাঃ) কে ধরে বেঁধে নিয়ে গিয়ে বাধ্য করা হয়েছিল হযরত আবু বকরের বায়েত গ্রহণের সাক্ষী হবার। স্বয়ং  ওমরের নেতৃত্বে হয়েছিল কাজটি। আলীর দরজায় লাথি মেরে ভেঙে নবীজির মেয়ে ফাতেমাকে রক্তাক্ত করেও ক্ষান্ত হয় নাই তারা।

এ কারণে বুকের পাঁজর ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গিয়ে অন্তঃসত্বা ফাতেমার রক্তক্ষরণ ও পেটের বাচ্চার মৃত্যু, এবং তিনমাসের মাথায় তার (ফাতেমার) মৃত্যুও কারো মনে দাগ কাটতে পারেনি সেদিন। পরবর্ত্তীতে ওসমানকে নিশঃসভাবে হত্যা করার পেছনেও ছিল সেই মতভেদ আর মতবিরোধ। হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে নবী পত্নি আয়েশার উটের যুদ্ধ বা জঙ্গে জামাল এ দশ হাজার মুসলমানকে মুসলমানরাই কি হত্যা করে নাই? কিন্তু কেন? আল্লাহ্ কি তাদের কাছে বিভক্ত হয়ে গেছেন? আমাদের আজকের পৃথিবীর চিত্রটি কি একটুকু পরিবর্তিত হয়েছে? মোটেও না।

কোন্ পথটি ঠিক, কারা  সঠিক মুসলমান এই বিরোধের অবসান আজো হয় নাই। তাই আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে ভ্রাতৃত্বের সংঘাত। কে যে প্রকৃত মুসলমান আর কে নয়, এই প্রশ্নটির ফায়সালা আজো অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

অধ্যাপক এম, আনোয়ারুল ইসলামের “ইসলাম কোন্ পথে” বইটিতে লেখক একটি জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় প্রশ্ন তুলেছেন কোনটি ইসলামের প্রকৃত রূপ? দেওয়ানবাগীর মোহাম্মদী ইসলাম নাকি আলীয়া কাদেরিয়া তরিকার ইসলাম? পাগলা ওলীর ইসলাম, তবলীগ জামাতের ইসলাম, মোসলমানী জিন্দেগীর ইসলাম, দয়াল বাবার মাজার কেন্দ্রিক ইসলাম, নলতার ইসলাম বা কুরআন হাদীস অনুযায়ী দ্বীন ইসলাম। কোনটি সঠিক পথে রয়েছে কে দেবে তার উত্তর! সম্প্রতি আমরা দেখেছি হেফাজত ইসলামের পৈশাচিক রূপের সংযোজন আর বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি ইসলামের রক্ষাকারী এইসব কান্ডজ্ঞানহীন, মূর্খ বিবেকহীন মৌ-লভীদের প্রলয়ংকারী বিভৎস্য রূপ দেখে। এরাই যদি হয়ে থাকে ইসলামের দাবীদার তাহলে সাধারণ ধর্মভীরু মানুষের অবস্থানটি কোথায়? কোন্ ইসলামকে অনুসরণ করছি আমরা? কারাই বা ইসলামের প্রকৃত ধারক, কে বলে দেবে সে কথা।

তাই বলছিলাম আল্লাহ্ কয় ভাগে বিভক্ত? কার অনুসৃত পথে পেতে পারি আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য?

আমাদের এই উপমহাদেশে বিভিন্ন ধর্মের শান্তিপ্রিয় মানুষের অবস্থান। অথচ তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে ইসলামের বিজয় ডঙ্কা বাজিয়েছেন অনেকেই। এটা নিশ্চয় আল্লাহ্ প্রেমী মানুষের কাজ নয়। এ কাজটি ইসলামী হাকিকতের অন্ধ অনুসারীদের কাজ, যারা নিজেরাই জানে না কোন্ পথের যাত্রী তারা।

আল্লাহর নামে ইসলামের বদৌলতে অনেক মানুষকে এই ধর্মান্ধ মূর্খেরা হত্যা করেছে নির্বিচারে। আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার চার যুগ পরেও তারা আজো সক্রিয় এদেশে। আল্লাহর নামে তাদের সকল অভিযান। তারাই ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভক্ত করেছেন বিভিন্ন নামে আর ফায়দা লুটেছেন মানুষের নির্মল সরলতার।

আমাদের এই উপমহাদেশে উপর্যুপরি ধর্মীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামায় হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছিল। সেই আদালত বিভিন্ন আলেমদের কাছে একটি প্রশ্ন রেখেছিলেন এবং জানতে চেয়েছিলেন খাঁটি মুসলমানের প্রকৃত সংজ্ঞা। কারণ, দেখা গেছে ইসলামী দলগুলি একে অন্যকে মেনে নিতে পারছেন না। তাদের মধ্যে দলাদলি, কোন্দল লেগেই আছে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মুসলমানের প্রকৃত সংজ্ঞায় কোন আলেম একমত হতে পারেনি। তারা প্রত্যেকই ভিন্ন সংজ্ঞা দান করেছেন ইসলামের। অতঃপর এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে উক্ত আদালত মত প্রকাশ করেছেন যেন “প্রত্যেক আলেমের মত আমরাও যদি আমাদের নিজস্ব একটা সংজ্ঞা দিতে চাই এবং সে সংজ্ঞা যদি অন্য সব আলেমদের দেওয়া সংজ্ঞা থেকে আলাদা হয়, তবে ভিন্ন মতভেদে আমরাও ইসলাম বহির্ভূত হয়ে যাই। তাছাড়া, যদি আমরা যে কোন কারণে একজন আলেমের সংজ্ঞা গ্রহণ করি, তবে তাঁর মতে আমরা মুসলমান হই।  কিন্তু অন্য সবার কাছে কাফের হয়ে যাই।

আজকে যদি পৃথক পৃথক আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি বা ফিরকায় পৃথক পৃথক উলেমাদের দ্বারা যদি রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার এবং শাসনতন্ত্র পরিচালিত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানটি যে কি হতো তা সহজেই অনুনেয়।

এ সবের মোট ফলাফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, শিয়া, সুন্নী, দেওবন্ধ, আহলে হাদীস, মাইজ ভান্ডারী প্রভৃতি কেউই মুসলিম নন। ‘মুসলিম’ এর সংজ্ঞা নির্ধারণে কোন আলেমই অন্য দলীয় আলেমের সঙ্গে একমত হয়ে পারেন না আজো। তাহলে কি এটা বলা ভুল হবে যে, আল্লাহ্ আজ বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত? এতেই কি ইসলামী পন্ডিতদের চিন্তাশক্তির পঙ্গুত্বতার প্রতিফলন স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় না?

দুঃখের বিষয় হলো আজকে এইসব শত বিভক্ত আলেমদের হাতেই ইসলামের বিধানসমূহ করায়ত্ব। তারা যাই বলেন-সেটাই হয়ে যায় ইসলামী হাকিকত নয়তো বা শরীয়া আইন। এরাই হলেন আজ ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষাকারী এবং কোরআন  সুন্নাহর খাঁটি অনুবর্ত্তী। শুধু তাই নয়, তারা মনে করেন যে, তাদেরই হক আছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার। তাই তারা কৌশলে ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায়ে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ইসলাম প্রীতির কাঁধে অস্ত্র রেখে নিজ স্বার্থ রক্ষায় মসজিদ- ভিত্তিক রাজনীতিতে নেমেছেন। এদেরই পেছনে অজস্র আর্থিক মদদ যোগাচ্ছে ধনকুবের আরব রাষ্ট্রগুলি, শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার তবিয়তে।

তাদেরই পরোক্ষ পরিচালনায় আমাদের মতো উন্নয়নগামী গণতান্ত্রিক দেশে চলছে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন ও  আরো কত আন্দোলনের উম্মাদ বহিঃপ্রকাশ । তারা ইসলামকে পুঁজি করে দেশে দেশে সৃষ্টি করেছেন অস্থিরতার ইতিহাস। জামাতে ইসলামের জেহাদী ডাকে অনেক তরুণ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এদেশে। একদিনে পাঁচশত বোমা ফাটিয়ে তারা ইসলামের নামে ভুলুন্ঠিত করেছে মানবতার সুকমোল মনুষ্যত্বকে। বস্তুতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করণে তারা ইসলামী তাবিজ দিয়ে বিভ্রান্ত করেছেন সাধারণ মানুষের অস্থিত্বকে। আর বিভক্ত করেছেন মহান আল্লাহর প্রকৃত সৌন্দর্যকে।

এই ইসলাম প্রেমীদের আসল উদ্দেশ্য যে, সরলপ্রাণ মুসলমানদের আবেগকে পুঁজি করে রাজনৈতিক কৌশলে ক্ষমতার সিংহাসনে বসা তা আজ আর কারো বুঝতে বাকি নেই। এরা ইসলাম প্রেমী নন, বরং ইসলাম ব্যবসায়ী। ইসলামের শ্লোগানে তারা গণতন্ত্রের মসনদ দখল করতে চান সহসা। এদেরই কর্মকান্ডে আজ আমরা বিভ্রান্ত, বিভক্ত বিভিন্ন অবয়বে। এসব ভন্ডদের রাজনীতি ব্যবসার অন্তরালে রয়েছে মোল্লাতন্ত্র বা রাজতন্ত্র কায়েমের খায়েস। গণতন্ত্র এদের চক্ষুশুল। এদেরই ফাতয়ায় উচ্ছন্নে গেছে অনেক সরলপ্রাণ আল্লাহর বান্দারা। এদের তফসীরুল কোরআনের বয়ানে রাজনৈতিক চর্চা প্রাধান্য পায় বেশী যা বিষিয়ে তোলে মানবতার মূল্যবোধকে।

আমার বুঝতে কষ্ট হয় কখনো কি এইসব ইসলামী আন্দোলনের প্রবক্তারা সৌদী আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে তাদের এইসব ইসলামী আন্দোলন চালাতে পেরেছেন? কেন তবে আমাদের এই ক্ষুদ্র সুন্দর দেশটিতে তাদের আগ্রাসন?

বলছিলাম আল্লাহ্কে কয়ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।  আর কারা করে চলেছেন এই কাজটি। আল্লাহ্ পাকের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হলে ধর্ম দিয়ে নয়, অন্তর দিয়ে অন্নেষণ করতে হবে তাঁকে। কারণ, তাঁর নিবাস আমাদেরই অন্তরে। সৃষ্টির মাঝেই প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে স্রষ্টার। আসুন, নিভৃতে তাঁকে অন্তরে আহ্বান করি। আর পরিতৃপ্ত হই তাঁর সান্নিধ্যে। সেই সাথে অন্তরের অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আলোর পথে ফিরে আসি।

This Post Has 4 Comments

Leave a Reply