You are currently viewing আল্লাহর চেয়ে কি রাসূল বড়?

আল্লাহর চেয়ে কি রাসূল বড়?

  • Post author:
  • Post last modified:June 7, 2021

“আল্লাহর চেয়ে কি রাসূল বড়” কথাটি শুনতে আযৌক্তিক মনে হলেও প্রশ্নটি করার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। কোরআন শরীফের বাংলা তরজমা যদি আমরা সবাই বুঝতে পারতাম তাহলে এ প্রশ্নটির অবতারণা করার কোন প্রয়োজন হতো না। কিন্তু যেহেতু আমরা আরবী ভাষাভাষীর লোক নই সেহেতু কোরআনের অনেক অনভিপ্রেত কথার মর্মার্থ আমরা উদ্ধার করতে পারি না। আমার কাছে কোরআন বুঝে পড়ার চেয়ে তা পড়ে শব্দার্থ অনুধাবন করতে পারা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষাগত জটিলতা হেতু আমরা অনেক সময়ে স্বীকার করে নিয়েছি যে, আল্লাহর চেয়ে তাঁর রাসূল বড়। কেননা আল্লাহকেও তাঁর রাসূলের প্রতি দরূদ বর্ষণ করতে হয়। শুধু তিনি একা নন, তাঁর ফেরেশতাগণ সহকারে তা করতে হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে চলুন দেখি সূরা আহযাবের ৫৬ নং আয়াতটি কি বলে।

إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلَـٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِىِّ ۚ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ صَلُّوا۟ عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا۟ تَسْلِيمًا (٥٦)

বাংলা অনুবাদঃ নিশ্চয় আল্লাহ রাহমাত প্রেরণ করেন নবীর প্রতি এবং তাঁর ফেরেশতারাও নবীর জন্য রাহমাত প্রার্থনা করে। হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরাও নবীর জন্য রাহমাত প্রার্থনা কর এবং তার প্রতি প্রচুর ‍পরিমাণে সালাম প্রেরণ কর (সূরা ৩৩, আহযাব ৫৬ আয়াত)।

আমাদেরকে নবীর প্রতি রাহমাত ও সালাম প্রেরণ করতে বলা হয়েছে কারণ, আল্লাহ্‌ ও তাঁর ফেরেশতাগণ তার প্রতি রাহমাত প্রেরণ করেন। সুতরাং আমাদেরও তা করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহকে কেনো নবীর প্রতি রাহমাত প্রেরণ করতে হবে? তাঁর অবস্থান কি নবীর চেয়ে নীচে রয়েছে? ভাষাগত জটিলতার কারণে অনেক সুক্ষ ব্যাপারসমূহ জটিল আকার ধারণ করে। কোরআনের কোন কোন স্থানে আল্লাহ্‌ নবীকে তাঁর কৃতকর্মের জন্য নিন্দা করেছেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছেন তাঁর কাছে (সূরা আন্‌-নিসা ১০৬ আয়াত)। এতে প্রতীয়মান হয় আল্লাহ্‌ সর্ব বিষয়ে উচ্চস্থানে আসীন। সবকিছুই তাঁর হস্তের করতলে। তিনিতো বিচার কর্তা, প্রজ্ঞাবান। তাঁকে কেনো রাহমাত বা সালাম প্রেরণ করতে হবে তাঁর অধীনস্থকে? কথাগুলো বোঝা একটু কষ্টসাধ্য বৈকি!

এই আয়াতটির তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস বলেন ঠিক এভাবে- আল্লাহ্‌ নবীর জন্য অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেতাগণও নবীর জন্য অনুগ্রহ কামনা করেন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তাঁর জন্যে অনুগ্রহ কামনা কর দু’আর মাধ্যমে এবং তাঁকে যথাযথভাবে সালাম জানাও, তাঁর নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ কর (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৫ দ্রষ্টব্য)।

ইসলামের একটি গোষ্ঠির অতিরিক্ত নবী ভক্তির সূত্র ধরে মৌলুদ বা “মিলাদ শরীফের” প্রচলন হয়েছে পাক-উপমহাদেশের দেশ সমূহে বিশেষতঃ বাংলাদেশে। আমাদের দেশে একসময় প্রায় সর্বত্র মিলাদ আর দরূদ পড়ার প্রচুর চলন ছিল। ক্রমান্নয়ে যদিও এই ব্যাপারটি কমে এসেছে তবুও একেবারে বিলুপ্ত হয় নাই চিরতরে। অথচ অন্য কোন দেশে এসবের রীতি চালু নেই। সৌদি আরব কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশে এ ধরনের মিলাদ পড়ার ঘটনা শোনে নাই কেউ। প্রক্ষান্তরে, মিলাদ পড়া কিংবা নবীজির গুনগান গাওয়াটি ইসলামে বি’দাত বলে গণ্য করা হয়েছে।   

“ইবাদতের নামে শিরক ও বি’দাত” পুস্তকের ২৪ পৃষ্ঠায় আবুল কালাম আযাদ উল্লেখ করেছেন— রাসূল (সাঃ) এর ওপর দরূদ ও সালাম পাঠের ক্ষেত্রে বি’’দাত করা হয়। বলা হয়েছে – রাসূল (সাঃ) এর ওপর স্বরচিত দরূদ ও সালাম পাঠ করা যেমনঃ- “ছালাতুন ইয়া রাসুলুল্লাহ আলাইকুম, সালামুন ইয়া হাবীবাল্লাহ্‌ আলাইকুম”, আজিফা নামে ছোট-বড় বইয়ের মাধ্যমে দরূদে লাখি, দরূদে তাজ, দরূদে হাজারী, দরূদে মুকাদ্দাস, দরূদে নারীয়া, দরূদে তৃনাজ্জিনা, দরূদে ফুতুহাত, দরূদে মাহী, দরূদে মোজাদ্দেদিয়া, দরূদে কাদেরিয়া, দরূদে চিস্তিয়া, দরূদে নকশবন্দিয়া ইত্যাদি ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক রচিত দরূদসমূহ পাঠ করা বি’দাত।

এছাড়া, ক্বেয়াম করা এবং ক্বেয়ামের মধ্যে ব্যক্তি বিশেষের রচিত ছালাত ও সালাম পাঠ করা বি’দাত। যেমন- ‘ইয়া নবী সালাম আলাইকা, ইয়া রাসূল সালাম আলাইকা’ মুস্তফা জানে রহমত লাখো সালাম, হাজারো সালাম, আসমালামাই নূরে চশমে আন্বিয়া …. ইত্যাদি।

বি’দাত হলো সালাত ও সালাম পেশ করার সময় দাঁড়ানো এবং ব্যক্তি বিশেষের রচিত সালাত ও সালাম পেশ করা। এর মধ্যে দাঁড়ানোর কারণ যদি রাসূল (সাঃ) কে আল্লাহ্‌ তা’আয়ালার মত উপস্থিত বা হাযের-নাজের মনে করা হয়, তাহলে দাঁড়ানো শুধু বি’দাত নয় বরং তা সু্ষ্পষ্ট শিরক। আর যদি রাসূল (সাঃ) কে হাযের-নাজের মনে করে দাঁড়ানো হয়, তাহলে তা হবে সম্পূর্ণ বি’দাত। কেননা, এর কোন শরয়ী ভিত্তি নেই।

আমাদের দেশের তথাকথিত আলেমদের কান্ডজ্ঞানহীন বক্তব্যে অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে চলেছেন শিরকি পথে। তার প্রথম নিদর্শন হলো— নবীকে নূরের নবী বলে প্রচার করা। অথচ রাসূল আমাদের মতোই আদম সন্তান। আর আল্লাহ্‌ আদম (আঃ) কে মাটি থেকেই সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সকল আদম সন্তান সৃষ্টির উৎস হলো মাটি। কোন নবী বা রাসূল এর ব্যতিক্রম নন (সূরা ত্বা-হা ৫৫, হা-মীম আস-সাজাদা- ৬, সূরা নূহ ১৭-১৮, সূরা রূম ২৩, সূরা মাইদা ১৫, সূরা তাওবা-১২৮, সূরা কাহাফ-১১০, সূরা বণী ইসরাইল ৯৩, মুসলিম হাদিস নং ১১৭১) দ্রষ্টব্য।

মজার ব্যাপার হলো আমরা যাকে নিয়ে এতো দোয়া দরূদ পড়ার আয়োজন করি তাঁর বিষয়ে এখনো অনেকেই কিছু না জেনেই তা করি। আমরা কেউ নির্দ্ধিধায় বলতে পারিনা যে তিনি বেহেশতবাসী হয়েছেন। কারণ, আমরাই তাঁর জন্যে প্রতিদিন পাঁচবার আযানের দোয়ার মধ্যে দিয়ে তাকে বেহেশতে পৌঁছানোর জন্য আল্লাহর কাছে বিনতী প্রার্থনা করে চলেছি আজো। আমরাই তো বলি “হে আল্লাহ্‌ দান করো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে বেহেশত যার প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছিলে।” ‘দান করো’ শব্দটি বর্তমান কাল বোঝায়। আর সে কথাটিই আমরা উচ্চারণ করি বারে বারে বিনতীসহকারে, আল্লাহর দরবারে যেন তিনি নবীজিকে বেহেশত দান করেন। তিনি ইতিমধ্যে বেহেশতে পৌঁছে গেলে তো আমাদের এহেন দোয়া চাইতে হতো না। আমাদের প্রার্থনার ভঙ্গিটি তাহলে এরকম হতো– হে আল্লাহ্‌, তোমায় ধন্যবাদ যে তুমি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে দান করেছো বেহেশতের সুমহান মর্যাদা।

কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবকে তো আর অস্বীকার করা যায় না!

সূরা আশ শুয়ারা ২৬: ৭৮-৮২ আয়াতে দেখা যায় নবীজির আকুতি আল্লাহর কাছে। যদি তাঁকে নিজ অপরাধের জন্য ক্ষমা চেয়ে আকুল প্রার্থনা করতে হয় আল্লাহর কাছে, তাহলে সেই আল্লাহ্‌ কিভাবে তাকে রাহমাত প্রেরণ করেন? দেখুন আয়াটিতে কি বলা হয়েছে।

ٱلَّذِى خَلَقَنِى فَهُوَ يَهْدِينِ (٧٨) وَٱلَّذِى هُوَ يُطْعِمُنِى وَيَسْقِينِ (٧٩) وَإِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ يَشْفِينِ (٨٠) وَٱلَّذِى يُمِيتُنِى ثُمَّ يُحْيِينِ (٨١) وَٱلَّذِىٓ أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِى خَطِيٓـَٔتِى يَوْمَ ٱلدِّينِ (٨٢)

 সূরা আশ শুয়ারা, ২৬: ৭৮-৮২

বাংলা অনুবাদঃ “যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি আমাকে সুপথ দেখান । এবং তিনিই আমাকে আহার করান এরং তিনিই আমাকে পানি পান করান। এবং আমি যখন অসুস্থ হই, তখন তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন। এবং তিনিই আমার মৃত্যু ঘটাবেন, অতঃপর পুনরায় জীবিত করবেন। এবং আমি আশা করি কিয়ামতের দিন তিনিই আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন (সূরা আশ শুয়ারা ৭৮-৮২ আয়াত) দ্রষ্টব্য। তাঁর এই আশাটি কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত?

এখানে নবীজি আশা করেছেন যে কিয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ তার অপরাধ ক্ষমা করবেন ও বেহেশত নসীব করবেন। তিনি যে আজো বেহেশতবাসী নন এটাই তার চাক্ষুস প্রমাণ। কারণ, কিয়ামত এখনো হয় নাই আর তার অপরাধের ক্ষমাও হয় নাই আজো। সে কারণেই তার জন্য বিনতী প্রার্থনা বা দোয়া চাওয়াটা মুমিনদের জন্য ফরয হয়ে পড়েছে।

আমাদের নবী প্রীতি অত্যান্ত বেশী মাত্রায় আমাদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করে বিধায় অনেক সময় আমরা ভেবে দেখিনা তাকে নিয়ে কি করে চলেছি আমরা। আল্লাহর চেয়ে অধিক মাত্রায় আমরা তাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি আর ভাবি যেন তিনিই আমাদের ত্রাণকর্তা। এভাবেই আমরা আল্লাহকে ছোট করি আর শিরক নামক গুনাহর ভাগীদার হই। তাকে নূরের নবী তৈরী বলে যারা ওয়াজ নসিয়ত করেন তারা হয়তো ভুলেই গিয়েছেন যে তিনি রক্ত-মাংসে গড়া আমাদের মতোই মানুষ। নিজেকে তিনি আল্লাহর প্রেরিত বলেই ক্ষান্ত ছিলেন কিন্তু তার উর্দ্ধে গিয়ে তাঁকে আরো বিশেষণে বিশেষিত করেছি আমরাই। এমনকি আল্লাহর নামের পাশে তার মুহাম্মদ (সাঃ) নামটিও ঝুলিয়ে রাখি সর্বত্র। দেখে মনে হয় তারা দ’’জনেই যেন অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত।

অথচ এটা যে অতি বড় গুনাহ্‌ (শিরক) তা আর কেউই ভেবে দেখেনা। সূরা বাকারাহ্‌ ২২ আয়াতে স্পষ্টতঃ বলা হয়েছে- অতএব তোমরা জেনে-বুঝে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করো না। এছাড়াও, সূরা মায়িদাহ্‌-র ৭২ আয়াতে বলা হয়েছে—“নিশ্চয় যে কেউ আল্লাহর অংশীদার ঠিক করে আল্লাহ্‌ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেন এবং তার আশ্রয়স্থল হয় দোযখ।” সূরা আন’আম এর ১৫১ আয়াতে বলা হয়েছে— “তোমরা তাঁর কোন অংশীদার নির্দ্ধারণ করবে না।” এরপরেও কি আমরা তা থেকে বিরত হয়েছি? মোটেও না। আমরাতো শুধু শোনা কথায় বিশ্বাসী। আমাদের সময় কোথায় সত্য উদঘাটনের চেষ্টা করার! তাই চলি গতানুগতিক পথে। দু’চারটি আয়াত উচ্চারণ করেই আত্নতৃপ্তি লাভ করি। সত্য বোঝার সময় পাই না। তাইতো অহরহ পড়তে হয় মিথ্যার অজানা ফাঁদে। এসব কারণেই বলছিলাম আমাদের কোরআন পড়ে বোঝা উচিত কি লেখা রয়েছে তাতে।

আসুন না, শুরু করি এই নতুন প্রচেষ্টা। সেইসাথে আল্লাহ্‌ তায়ালাকে দেই তাঁর প্রাপ্য সম্মান, ভক্তি ও প্রশংসা।   

আরও জানুন: আপনার জন্য হালাল আর সবার জন্য হারাম

Leave a Reply