You are currently viewing রহস্যে-ঘেরা পবিত্র নগরী

রহস্যে-ঘেরা পবিত্র নগরী

  • Post author:
  • Post last modified:April 4, 2022

বিত্র নগরী বলতে আপনি কি বোঝেন? যে নগরীতে পবিত্র লোকদের বসবাস? নাকি যেখানে গেলে মানুষ পবিত্রতায় গড়াগড়ি খায়? পবিত্র নগরী বিষয়ে আপনার ধারণাটি যাই থাকুক না কেন, পবিত্র নগরী বলতে আমরা মক্কা-মদিনাকেই বুঝি। আর সেই অপার্থিব পবিত্রতার ছিঁটে-ফোঁটা অংশ গ্রহণের প্রত্যাশায় আমাদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে সংযোজন করি মক্কা-মদিনার নাম। তারই ফসল মক্কা ট্রেডার্স, মদিনা হোটেল ইত্যাদি, ইত্যাদি।

এসব সন্তানেরা কোন্‌ সব পীর ফকিরের ঝাড়-ফুক গ্রহণ করেছেন তা তারাই জানেন ভালো। কিন্তু তাতে করে তাদের জীবনে যেমন পবিত্রতার লেশমাত্র দৃশ্যমান হয়না, তেমনি হয় না সেইসব পবিত্র নামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিফলনে।

বলছিলাম পবিত্র নগরী বিষয়ে কিছু কথা। কবে কখন সেই নগরীটি পবিত্রতায় ভেসে উঠেছে তা সবার অজানা। সেখানকার অধিবাসীদের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার কোনটাতেই পবিত্রতার লেশমাত্র নেই। তবুও তারা আমাদের অন্তরের মণিকোঠায় পবিত্রতম বলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। প্রতিবছর হজ্বের নামে সস্তায় “হাজী” বনে যাবার সনদপত্র সেখান থেকেই অর্জন করে বাংলা মায়ের অযোগ্য সন্তানেরা।

দুঃখিত, অযোগ্য সন্তান বললাম এ জন্যে, কারণ সেখানে কিছুদিন বিচরণ করে আসলে স্বীয় নামের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায় ‘হাজী’ শব্দটি। কিন্তু কে দেয় এই শাব্দিক উপাধি? কি লাভ হয় তাতে? সেখান থেকে ফিরে আসলেই কি আমরা যোগ্যতা অর্জন করি ভালো মানুষ হবার?

ব্যাপারটি হাস্যকর বটে! নাম বা উপাধির বদৌলতে কারো চারিত্রিক পরিবর্তন হয় না। এতে শুধু আত্মগর্ব অনুভব করা যায়, অন্য কিছু নয়। বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে যা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ। সেটা হলো- কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। অর্থাৎ কয়লা কয়লাই থাকে। তাকে কেউ সাদা কয়লা উপাধি দিয়েও সাদা করতে পারে না। সেলিম মিয়া যতই সৌদির ধূলায় পদচারণ করে ফিরে এসে হাজী সেলিম মিয়া নামে পরিবর্তিত হন না কেন, তার চরিত্রের প্রকাশ ঘটবে তার আচরণে, হাজী উপাধিতে নয়।

মানুষের পরিচয় তার আচরণে বা মনুষ্যত্বে। কিন্তু সেই মনুষ্য সন্তানগণ যখন পশুবধ আচরণ করে আর নির্দ্বিধায় গলাবাজি করে “আলহামদুলিল্লাহ্‌” উচ্চারণে, তখন আর লজ্জা ঢাকার অবকাশ থাকেনা আমাদের।

“আলহামদুলিল্লাহ্‌” কথাটা বললাম এজন্যে কারণ, প্রত্যেকের মুখে মুখে এর উচ্চারণ ঘটে আজকাল।

রিক্সার গ্যারেজে প্রবেশ করলেই কেউ যেমন রিক্সায় পরিণত হয় না তেমনি পবিত্র নগরীতে ভ্রমণ করলেই সে পবিত্র হয়ে যায় না।

বস্তুত: কা’বা শরীফের অবস্থানের কারণে মক্কা নগরীকে পবিত্র নগরী হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্বাসটি কেবল অতি ধর্মান্ধ ইসলাম অনুসারীদের মধ্যেই বিদ্যমান। বলা হয়ে থাকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত ইসমাইল দু’জনে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন, কিন্তু আমাদের যদি ইতিহাসের কিঞ্চিৎ জ্ঞান থেকে থাকে তাহলে আমরা নিজেরাই তা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। ইতিহাস কিংবা ভৌগলিক রেকর্ডের কোথাও এর উল্লেখ নাই। আছে শুধু কল্পনাপ্রবণ কিছু আরব্য উপন্যাসের গল্পের সমাহার।

ইতিহাসের পাতায় স্পষ্টত: উল্লেখ রয়েছে যে ইব্রাহীম (আঃ) উর্‌ থেকে কনান পর্যন্ত গিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালার আহ্বানে। তবে যখন তিনি তাঁর অদ্বিতীয় পুত্র ইসহাক (আঃ) কে কোরবানি করতে গিয়েছিলেন “মোরায়রা পর্বতে”, সেটা ছিল বেশ কিছু মাইল উত্তর-পশ্চিমে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রথম পুত্র যে তাঁর বাঁদি হাজেরা বিবির ওরশে জন্মগ্রহণ করে, তার নাম ইসমাইল। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর স্ত্রীর (সারা) অতি বার্ধক্যতা সত্ত্বেও তার ওরশে হযরত ইসহাক (আঃ) এর জন্ম হয়। তাঁকেই হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কুরবানি করতে উদ্যত হন। অথচ মুখরোচক গল্প হিসেবে ইসলামের স্বর্ণ-সন্তানেরা ইসমাইলের কথা উল্লেখ করে বারে বারে। এখানেই ইতিহাস ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মিথ্যা কারসাজিতে।

হযরত ইব্রাহীম বা ইসমাইল কোনদিন ১২০০ (বারোশত) মাইল অতিক্রম করে দক্ষিণে আরবের মরুভূমিতে প্রবেশ করেন নাই। বাস্তবে তা ছিল অবাস্তব। সপ্তম শতাব্দীর পূর্বে পৃথিবীর কোন মানচিত্রে মক্কা-নগরী বা সৌদি আরবের উল্লেখ নাই।

ইব্রাহীম (আঃ) এর মৃত্যুতে তাঁর দুই সন্তান- ইসহাক ও ইসমাইল তাঁকে কবরস্থ করেন (Machpelah) ম্যাকফেলাহ্‌ এর গুহায়। জায়গাটি ইব্রাহীম (আঃ) ক্রয় করেছিলেন হিত্তিয়দের কাছ থেকে। সেখান থেকে তাঁর বারোশত মাইল পদব্রজে যাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তার কোন প্রয়োজনও ছিলনা।

আমরা এখন কল্পিত মক্কা-নগরীকে যে কল্পনার পবিত্রতায় অংকন করি, তা নিছক বানোয়াট ও উদ্দেশ্য-প্রসূত।

মক্কা-নগরী ও কা’বাগৃহ ছিল মূর্তিপূজার আস্তানা। তিনশত ষাটটি মূর্তি ছিল কা’বাগৃহের অভ্যান্তরে। একথাটিও মনে রাখা দরকার যে ইব্রাহীম (আঃ) মূর্ত্তিপূজারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বণী ইস্রাইল জাতির সন্তান। এই সহজ ইতিহাসটিও আমাদের আলোচনায় উপেক্ষিত হয় বারে বারে।

অতএব যত পদবী আর টাইটেল আমরা নামের পিছনে সংযুক্ত করি না কেনো, তা কখনোই আমাদের পবিত্রায় ভাসাতে পারে না। কথিত সেই পবিত্র নগরী যে কত অপবিত্রতায় ভেসে চলেছে তা শুধু তারাই ভালো জানেন যারা ইতিমধ্যে সেখানে পদার্পণ করেছেন কিংবা ৭ চক্কর খেয়েছেন মক্কার সেই কালো চাদরে ঘেরা গৃহটির চারিদিকে।

আমরা অত্যন্ত ধর্মকাতর বিধায় অনায়াসে প্রভাবিত হতে পারি শয়তানের মিথ্যা কারসাজিতে। কিন্তু এখন সময় এসেছে আমাদের বিবেক আর প্রজ্ঞাকে ব্যবহার করার।

বস্তুত: কা’বাগৃহের ব্যাপারে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কিংবা ইসমাইল (আঃ) কারো কিছুই করার নাই। জায়গাটি ছিল সম্পূর্ণরূপে মূর্তি-পূজারীদের অধীনে। মিসরীয় প্রফেসর ও আরবি সাহিত্যের গবেষক ডঃ তাহা হুসাইন (Taha Hussayn) বলেছে এ কথা। বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন ইসলামের উৎপত্তির সময়কালে এর নির্মাণ হয়েছে। ইসলাম তার ধর্ম বিস্তারের কারণে তা ব্যবহার করেছে। ডঃ তাহা একজন পণ্ডিত ব্যক্তি এবং তিনি তাঁর বিচক্ষণতায় মিসরের শিক্ষামন্ত্রীর পদে অধিস্থ হয়েছিলেন।

তার উল্লেখিত বক্তব্যটি নিজের গবেষণার ফসল। তিনি নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে ইসলামী পণ্ডিতদের মক্কা বিষয়ক বক্তব্যসমূহ বিভ্রান্তিমূলক। এখন এসব সত্যতার বিশ্লেষণ করাটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার।

আসুন, নিজেই চেষ্টা করে দেখি এই রহস্যময় নগরীর সত্যতা উন্মোচন করতে সক্ষম হই কিনা।

 

Leave a Reply