You are currently viewing বাবা ও পুত্রবধুর বিবাহ: নবীজির হালালীকরণ বিষয়ক

বাবা ও পুত্রবধুর বিবাহ: নবীজির হালালীকরণ বিষয়ক

  • Post author:
  • Post last modified:January 24, 2022

পৃথিবীতে এমন কোন ব্যক্তি আজ অবধি খুঁজে পাওয়া যাবে না যে, তার ছেলের স্ত্রীর ঝলসানো রূপে লাফিয়ে উঠে তাকে বিয়ে করে নিজ ঘরে নিয়ে আসতে পারে। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয়েই যায়, তাহলে নিশ্চিত ঘরছাড়া, সমাজচ্যুত হতে হবে মানুষের ছিঃ ছিঃ ধিক্কারে। কারণ, মানুষের অন্তরে নোংড়ামী থাকলেও তা ধৈর্যের সীমারেখা অতিক্রম করতে পারে না। আমাদের দেশে নিত্য নৈমিত্তিক ধর্ষণ চিত্র ক্রমশঃ বিষিয়ে তুলছে মানুষের অন্তর। তার যথাযথ বিহিত বা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে এর পরিধি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে। তবে আজ পর্যন্ত কেউ শোনে নাই যে কোন শশুর মহাশয় তার ছেলের স্ত্রীকে জব্দ করে নিজের ঘরণী বানিয়েছে আর নির্দ্দিধায় ফতোয়া দিয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়েছে নির্লজ্জের মতো।

কখনো কি চিন্তা করতে পারেন যে, আপনার সদ্য বিবাহিত সুন্দরী স্ত্রীকে আপনার বাবার পছন্দ হয়ে গেল নিজ অধিকারে নিয়ে আসার। আর তৎক্ষণাত “মাশাআল্লাহ্”, “সুবাহানল্লাহ্” বলে ছেলেকে বাধ্য করলেন বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য। যাকে আপনি বাবা বলে ডেকেছেন তার জন্য মান-সম্মানের ভয়ে কিংবা ফতোয়ার প্রভাবে আপনাকে অবশেষে বাস্তবতা মেনে নিতে হলো এবং ত্যাগ করতে হলো প্রাণপ্রিয় জীবনসঙ্গিনী স্ত্রীকে “তালাক” নামক শব্দের কষাঘাতে।

অতঃপর একদিন আপনার চোখের সামনেই আপনার পিতা আপনার প্রিয় স্ত্রীকে আপনার চোখের সামনে নিজ স্ত্রীর মর্যাদায় ঘরে তুলে নিলেন এক হাস্যকর রসিকতায়। আপনার অন্তর এক বিষন্ন পীড়ায় বির্দীণ হলেও কিছু যায় আসেনা আপনার সম্মানিত পিতার। তিনি ধুমধাম করে বাসর ঘর সাজালেন, দাওয়াত করলেন বন্ধু-বান্ধবদের আর অবশেষে স্বর্গ সুখ অনুভব করলেন আপনার বেচারী স্ত্রীর বিছানায়। এই যদি হয় বাবাদের ধর্ম, কর্ম অভিলাষ, তাহলে কি এক মহা থাপ্পর পড়বে না মানবিকতার গালে-মুখে?

আপনার কথা আর কেউ মনে রাখবে না সারাব পাত্রে চুমুক দেবার পর। কিন্তু আপনার মনে থাকবে, শুধু আপনার হারানো স্ত্রীর কথা, স্মৃতি। আর তার সৌন্দর্য্যরে কথা। কেনো তাকে আপনার বুক থেকে ছিঁনিয়ে নেয়া হলো তা আর কেউ জানতেই চাইবে না। কারণ, আপনার বাবা অতি সম্মানিত এক ব্যক্তি এবং তার প্রভাবে ঢাকা পড়ে যাবে আপনার অন্তরের সমগ্র বেদনা। এরপরে আয়াত নাজিল হবে যে আপনি পোষ্যপুুত্র। পোষ্যপুত্রের স্ত্রীকে দখল করা জায়েজ আছে বাবার জন্যে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজকের সভ্য জগতে এ ঘটনার অবতারণা হলে তা কঠোর হস্তে বিচারিত হবে বৈকি। আর সেইসাথে কান টেনে ছিঁড়ে ফেলা হবে সেইসব ব্যক্তিদের। যারা এহেন বিকৃত তামাশায় ধন্য করেছেন ইসলামী হাকিকত। তবে আশ্বাসের বিষয় এই যে, এ ঘটনা আর কখনো ঘটে নাই, ঘটবেও না পৃথিবীর কোথাও। পোষ্যপুত্র আর ক্রীতদাস এক নয়। পোষ্যপুত্র মানে পুত্রতুল্য ব্যক্তি, যে একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত যার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে পরিবারে প্রতিটি সদস্যদের মতোই। অথচ আমাদের ধর্মের দিশারী ব্যক্তিটি তা পালনে ব্যর্থ হলেন কেন? কি ভাবে পারলেন তিনি এই সীমারেখা অতিক্রম করতে? আল্লাহ্ কি তাহলে কথায় কথায় তার ইচ্ছায় ওঠেন-বসেন? তাহলে কি আল্লাহর বৈশিষ্ট্য আর পবিত্রতা ক্ষুন্ন হচ্ছে না? হচ্ছে বৈকি। একেই বলে ধর্মের বেচা-কেনা।

যুগে যুগে ধর্মের ভন্ডামীর ছত্রছায়ায় মানুষ আল্লাহর নাম ব্যবহার করে এসেছে, আজো করছে। তবে এ কথা সবারই জানা যে আল্লাহ্ তায়ালা মহান ও দয়ালু। তিনি এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে আপনার অন্তরের নাড়ী ছেঁড়া চিৎকার তাঁর দরবারে পৌঁছাতে হবে। তা হবার আগেই তিনি আপনার ভগ্নচুর্ণ অন্তরকে ঘিরে রাখবেন তাঁর ভালবাসা দিয়ে। আল্লাহর নাম ভাঙিয়ে যারা চলে তাদের কথাই আলাদা । তারা নিজ উদ্দেশ্য হাসীল কর্মে আল্লাহর নাম বেশী উচ্চারণ করে বেড়ায়।

সুরেলা কন্ঠে কোরআন বুঝে পড়ার চেয়ে কোরআন পড়ে আমাদের বোঝা উচিৎ কি বলা হয়েছে সেখানে। আরবী ভাষায় সুরেলা কন্ঠে কোরআন উচ্চারণ করতে গিয়ে আমরা বুঝতে অপারগ হই কি বলছি আর কাকে বলছি সে কথা। যদি নিজ ভাষায় এর মানে বুঝে পড়তে পারতাম তাহলে হয়তো সাবধানে উচ্চারিত হতো আমাদের দোয়া কালাম। আর ভেবে দেখতাম এর পেক্ষাপট সমূহ। কিন্তু তা তো আর হবার নয়। কারণ, না বুঝে কোরআন পড়াটাই শ্রেয় বলে আমাদের শেখানো হয়েছে, হচ্ছে অবারিত।

 যদি বলা হয় আমাদের নবীজি তার পোষ্যপুত্র যায়দ ইব্নে মুহাম্মদ (রাঃ) এর স্ত্রী যয়নব বিনতে জাহশ (রাঃ) কে তার স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে নিজের ঘরণী বানিয়েছেন এবং তাতে আল্লাহর সমর্থন রয়েছে তাহলে কি চম্কে উঠবেন? হয়তো না। কিন্তু ঘটনাটির বিস্তার এভাবেই।

একদিন নবীজি তাঁর পালক পুত্র যায়দ ইব্নে মুহাম্মদ এর বাসায় গেলেন যখন যায়দ ছিল অনুপস্থিত। তিনি তার বাসায় ঢুকতেই দেখতে পেলেন যায়দের সদ্যবিবাহিত সুন্দরী স্ত্রী যয়নবকে। এ সময়ে যয়নবের শরীরে ঢিলেঢালা পোশাক ছিল যা প্রায় অনাবৃত ও দৃশ্যমান। আমাদের নবীজি নির্দ্ধিধায় (যয়নবের) তার রূপের প্রশংসা করলেন এবং তার কাছে জানতে চাইলেন যায়দের অবস্থান কোথায়। উত্তরে যয়নব বললো যে বাসায় নাই। অতঃপর নবীজি তার রূপের গুনগান করতে করতে ফিরে গেলেন নিজগৃহে।

ইতিমধ্যে যয়নবের বুঝতে বাকি রইলো না নবীজির ইচ্ছাটুকু। তাই তার স্বামী যায়দ বাসায় ফিরে আসা মাত্রই যয়নব শশুড়ের আগমন ও তাঁর ইচ্ছার প্রকাশ (যার আভাস তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন) তা বললো। ব্যাপারটি হৃদয়ঙ্গম করার পর যায়দ তার পিতার মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে গিয়ে স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ও তাকে পিতার হাতে তুলে দেওয়ার অভিপ্রায়টির সমর্থন জানালো। যায়দের ভালভাবেই জানা আছে তার স্ত্রীর প্রতি পিতার অভিরুচি আর অভিব্যক্তির ভাষা।

সুতরাং বিষয়টি আর দীর্ঘায়িত না করে সে তার স্ত্রীকে বিচ্ছেদের মধ্যে ছেড়ে দিতে চাইলো যাতে তার পিতা তাকে গ্রহণ করে নিতে পারেন। কিন্তু মানুষের কাছে কিভাবে তা বোঝানো সম্ভব? সমাজের চোখেও তা দৃষ্টিকটু হওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে মুহাম্মদ (সাঃ) একটু সমস্যায় পড়লেন। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁকে এ আয়াত দান করলেন যাতে স্পষ্টত বলা হয়েছে-

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَـٰلًا مُّبِينًا 36

অর্থঃ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা কোন মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো পথভ্রষ্ট হবে (সূরা আহযাব ৩৩:৩৬ আয়াত)।

উল্লেখিত আয়াত নাযিল হওয়ার মধ্য দিয়ে যয়নবকে নিজের স্ত্রী হিসেবে অর্জন করতে অর্থাৎ হালাল করে নিতে আর কোন বাধা থাকলো না। এভাবেই নবীজি তাঁর খায়েস মিটিয়েছেন যয়নবকে বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে নিজের ঘরে তুলে নিয়ে। বেচারা যায়দ মনের দুঃখে নিশ্চয় আনন্দ চিৎকার করে নাই। বরং বিরহের আতিশয্যে নিরবে দূরে সরে গেছে স্ত্রীকে বাবার হাতে তুলে দিয়ে। আল্লাহর আয়াত অনুযায়ী তার বা তার স্ত্রীর কোন অধিকার রইলো না এই লালসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। এটাই যদি হয়ে থাকে ইসলামী হাকিকত তাহলে আর কোন ব্যক্তির প্রতিবাদের ভাষা থাকলো না। আল্লাহর নবী বলে কথা!

وَإِذْ تَقُولُ لِلَّذِىٓ أَنْعَمَ ٱللَّهُ عَلَيْهِ وَأَنْعَمْتَ عَلَيْهِ أَمْسِكْ عَلَيْكَ زَوْجَكَ وَٱتَّقِ ٱللَّهَ وَتُخْفِى فِى نَفْسِكَ مَا ٱللَّهُ مُبْدِيهِ وَتَخْشَى ٱلنَّاسَ وَٱللَّهُ أَحَقُّ أَن تَخْشَىٰهُ ۖ فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا زَوَّجْنَـٰكَهَا لِكَىْ لَا يَكُونَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ حَرَجٌ فِىٓ أَزْوَٰجِ أَدْعِيَآئِهِمْ إِذَا قَضَوْا۟ مِنْهُنَّ وَطَرًا ۚ وَكَانَ أَمْرُ ٱللَّهِ مَفْعُولًا 37

অর্থঃ “স্মরণ করো আল্লাহ্ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ তুমি তাকে বলেছিলে, “তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ এবং আল্লাহকে ভয় কর।” তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছো আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তুমি লোক-ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই তোমার পক্ষে অধিকতর সংগত। তারপর যায়দ যখন যয়নবের সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করলো তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করলাম। যাতে মু’মিনদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহ ছিন্ন করলে সেসব রমণীকে বিয়ে করায় মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয়। আল্লাহর আদেশ কার্যকারী হয়েই থাকে” (সূরা আহযাব ৩৭ অয়াত)।

আল্লাহ্ তায়ালা মহা দয়ালু হওয়া সত্ত্বেও একটু সহানুভূতি দেখালেন না যায়দ কিংবা যয়নবকে? সম্পূর্ণ ভুলেই গেলেন তাদের কথা? এটা তো বিশ্বাসের অযোগ্য। স্বীয় স্বামীকে তালাকের কষাঘাতে জর্জরিত করে যয়নব নিশ্চয় পুলকিত হয়ে ওঠে নাই নবীজির বিছানায়! অথচ এটাই হয়েছিল তার পরিণতি। এটাই ছিল নিয়তি তাদের। এজন্যেই বোধকরি নবী পত্নী আয়েশা প্রায়শঃই বলতেন আপনার আল্লাহ্ তো আপনার জন্যে সব কিছু করেন।

উল্লেখিত ৩৬ আয়াতের বিষয়ে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন (বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত, পৃষ্ঠা নং ৬৬ ৩য় খন্ড) আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে, আদেশ প্রদান করলে বিবাহ কিংবা অন্য বিষয়ে কোন মু’মিন পুরুষ (যায়দ) কিংবা মু’মিন নারী (যয়নবের) সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অবকাশ থাকবে না। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীতে পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার থাকবে না, ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ্ ও রাসূলকে অমান্য করলে, প্রদত্ত নির্দেশের বরখেলাপ করলে সে তো স্পষ্টতই পথভ্রষ্ট হবে, আল্লাহর আদেশ ও নির্দেশের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ভুল করবে।

অর্থাৎ এক কথায় যা বোঝায় তা হলো, যয়নব কিংবা যায়দের কোনরকম আপত্তি চলবে না যখন নবীজির নজর পড়বে তার স্ত্রীর দিকে। এটাই হলো ঘর ভাঙা-গড়ার খেলা। তাও আল্লাহ্ সোবহানাল্লার নামে।

দ্বিতীয়তঃ যে আয়াতটি বর্ণনা করতে চাই সেটাও নাযিল হয়েছে সূরা আহ্যাবে। অর্থাৎ এটাও যয়নব ও নবীজির বিবাহ সংক্রান্ত। অন্য অর্থে, এটাও বাবা ও পুত্রবধুর বিবাহ বিষয়ক।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্নে আব্বাস (রাঃ) এর তাফসীরে এভাবে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। “স্মরণ কর, যখন তুমি বলছিলে সেই ব্যক্তিকে, যার প্রতি আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন ইসলাম গ্রহণের তাওফীক প্রদান করে। অর্থাৎ যায়দকে আর তার প্রতি তুমিও অনুগ্রহ করেছ তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে, তুমি বলেছিলে যে, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখ, তাকে তালাক দিবে না আর আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহর ভয় মনে পোষণ কর, ওর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করো না, তুমি তো তোমার অন্তরে যা গোপন রাখছো, হৃদয়ে ওই মহিলার প্রতি ভালবাসা পোষণ ও তাকে বিয়ে করার ইচ্ছে করেছ আল্লাহ্ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন, কোরআনে তা বর্ণণা করে দিচ্ছেন। তুমি লোক-ভয় করছিলে, এ বিষয়ে জনসাধারণের সম্মুখে লজ্জা পাবার ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার জন্যে অধিকতর সংগত যে তাঁর সম্মুখে লজ্জা পেতে হয় নাকি।

অতঃপর যায়দ যখন তার সাথে বিবাহ সম্পর্ক ছিন্ন করল, অর্থাৎ যায়দের তালাক প্রদানের পর যয়নব ইদ্দত পালন করল, তখন আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ করে দিলাম, যাতে মু’মিনদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীর সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে, মৃত্যু কিংবা তালাকের মাধ্যমে দাম্পত্য সম্পর্কে বিচ্ছেদ ঘটালে এবং ইদ্দত শেষ করলে, সে সব রমণীকে বিবাহ করতে মু’মিনদের কোন বিঘ্ন না হয়, পাপ ও দোষ না হয়। আল্লাহর আদেশ, মুহাম্মদ (সাঃ) এর সাথে যয়নবের বিয়ের সিদ্ধন্ত কার্যকারী হবেই, অবশ্যই বাস্তবায়নযোগ্য। নবীজীর বিষয়টি আলাদা, তিনি যা করেন তাতে আল্লাহর সমর্থন তো থাকেই তা সত্ত্বেও তার অনুসারীদের জন্য তিনি একই কাজ অনুশীলন করার তাওফীক দান করেছেন। সুবাহানাল্লাহ্! অন্য ব্যাখ্যায় আল্লাহর আদেশ অর্থাৎ আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুষ্ঠিত হবেই হবে (তাফসীরে ইব্নে আব্বাস (রাঃ) ৩য় খন্ড, ইসলামী ফাউন্ডেশন ঢাকা থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ৬৭ দ্রষ্টব্য)।

তিরমিযী শরীফে ব্যাপারটি বর্ণিত হয়েছে এভাবেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাকে (যয়নবকে) বিয়ে করলেন তখন লোকেরা বলতে লাগল, তিনি নিজের পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ্ আয়াত অবতীর্ণ করেন (অনুবাদ), “মুহাম্মদ তোমাদের পুরুষ লোকদের মধ্যে কারো পিতা নন, বরং আল্লাহর রাসূল ও সর্বশেষ নবী (৩৩,৪০)। রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) তাকে পোষ্যপুত্র বানিয়েছিলেন। তিনি (যায়দ) তখন বালক ছিলেন। তিনি তাঁর নিকট থাকলেন ও ক্রমান্নয়ে বেড়ে উঠলেন। তাকে যায়দ ইব্নে মুহাম্মদ বলে ডাকা হত। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তায়ালা আয়াত অবতীর্ণ করেন, “পোষ্য পুত্রদেরকে তোমরা তাদের পিতার সাথে সম্পর্ক সূত্রে ডাকো, এটা আল্লাহর নিকট অধিক ন্যায়সঙ্গত। আর তাদের পিতৃপরিচয় তোমরা যদি না জান, তবে তারা তোমাদের দীনী ভাই এবং সাথী (৩৩, ৫)। অর্থাৎ অমুক অমুকের বন্ধু এর অমুক অমুকের ভাই।

এটাই মহান আল্লাহর নিকট অধিক ন্যায়সঙ্গত কথা অর্থাৎ আল্লাহর নিকট অধিক ন্যায়নুগ কথা (মুসলিম হাদীস ৩১৪৫, তিরমিযী শরীফ, পৃষ্ঠা ৯০৩ দ্রষ্টব্য)। এছাড়াও একই পৃষ্ঠায় হাদীস নং ৩১৫০-৩১৫২ তে ঘটনাটি বিস্তারিত বর্ণিত রয়েছে।

অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই কিভাবে (পুত্রবধু) যয়নবকে ছিনতাই করে নিজের ঘরণী করে তুলে আনা হয়েছে লালসা চরিতার্থ করার জন্যে। এই বিয়ের পর মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর বন্ধুদের দাওয়াত করলেন ভুরী ভোজের। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, তিনি যাদের নাম উল্লেখ করে বলে দিয়েছেন এবং পথিমধ্যে আমার সাথে যাদের দেখা হয়েছে আমি তাদের সবাইকে দাওয়াত করে নিয়ে এলাম। বর্ণনাকারী জাদ আবু ওসমান বলেন, আমি আনাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের মোট সংখ্যা কত ছিল?

তিনি বলেন, প্রায় তিন শত। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাকে বলেন হে আনাস, হাইসের বারকোষ নিয়ে এসো। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, দাওয়াতকৃত লোকেরা এলে তাদের ভীড়ে চত্বর ও হুরা ভরে গেল। নবীজি (সাঃ) বলেন, দশ দশজন করে বৃত্তাকারে বসাও এবং প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজের কাছের খাবার খায়। বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা পরিতৃপ্তি সহকারে খাবার খেল। একবার খেয়ে চলে গেলে অপর দশ দল খেতে বসত। এভাবে সবাই খেল। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি আমাকে বলেন, হে আনাস! বারকোষ তুলে নিয়ে যাও। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি তা উঠিয়ে নিলাম, কিন্তু বলতে পারব না, যখন আমি হাইসের বারকোষ রেখে ছিলাম তখন কী তাতে অধিক হাইস ছিল না যখন তুলে নিলাম তখন বেশী ছিল (তিরমযী শরিফ পৃষ্ঠা ৯০৬ দ্রষ্টব্য)।

এর পরের ঘটনাপ্রবাহ হয়তো আমাদের অনেকের জানা আছে। অতিথীদের খাওয়া শেষে তাদের বিদায় হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইলেন নবীজি। তাঁর সদ্য বিবাহিত স্ত্রী দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে রইলেন। অতিথীরা খাওয়া শেষ হওয়ার পর গল্প গুজবে মত্ত হয়ে থাকায় নবীজি অস্বস্তি অনুভব করছিলেন। অতঃপর অতিথীরা নবীজির বিরক্তিপূর্ণ চেহারা দেখে উঠে পড়লেন এবং একে একে বিদায় নিলেন।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে নবীজির কাছে আয়াত নাযিল হলো এরপর তিনি বাইরে এসে তা পাঠ করে শোনালেন। আয়াতটি এ রকমঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা বিনা অনুমতিতে নবীর গৃহের মধ্যে ঢুকে যেওনা এবং খাওয়ার জন্য এসে অপেক্ষায় থেকো না। যদি তোমাদের খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেওয়া হয় তবে অবশ্যই আসবে, কিন্তু খাওয়া-দাওয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সরে পড়বে এবং কথাবার্তায় মশগুল হবে না তোমাদের এরূপ আচরণ নবীকে কষ্ট দেয় কিন্তু সে লজ্জায় কিছুই বলে না। আর আল্লাহ্ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না। নবীর স্ত্রীর নিকট তোমাদের কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে পর্দার আড়াল থেকেই তাদের নিকট তা চাও। তোমাদের এবং তাদের অন্তরের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এটাই উত্তম পন্থা। আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেওয়া এবং তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদের বিয়ে করা তোমাদের জন্য কখনো বৈধ নয়। এটা আল্লাহর নিকট অতি বড় গুনাহ্ (৩৩,৫৩)।

জাদ (রাঃ) বলেন, আনাস (রাঃ) বলেছেন, আমি সবার আগে এ আয়াত সম্পর্কে অবগত হই এবং সেদিন থেকেই নবী করিম (সাঃ) এর স্ত্রীগণ পর্দা করেন (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৩১৫৬, পৃষ্ঠা ৯০৬ দ্রষ্টব্য)। বোখারী ও মুসলিম শরীফেও একই কথার বর্ণনা রয়েছে।

এই ঘটনাটির প্রেক্ষাপটে আমাদের সুস্থ বিবেকের কিঞ্চিৎ প্রশ্নের উদয় হয় বৈকি! আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে এটাই যদি হয়ে থাকে আল্লাহর বিধান (যা অবাস্তব বা অগ্রহণযোগ্য) তাহলে কোন আল্লাহর অনুসারী আমরা? কিংবা কোন উন্মাদ ব্যক্তিকে আমরা নবী উপাধি দিয়ে সম্মানের তখতে বসিয়েছি যিনি আমাদের নাড়ী ছেঁড়া বন্ধন স্ত্রীকে ছিনতাই করতে পারেন আল্লাহর নামে? ডাকাত কিংবা চোর আসে চুরি, ছিনতাই কিংবা জীবন বিনষ্ট করতে। আল্লাহ্ তায়ালা তো আমাদের জীবনদাতা, রক্ষাকারী। তিনি কেনো বিধান দিবেন আমাদের জীবন সঙ্গিনীকে ছিনিয়ে নেবার? বিষয়টি কি বিশ্লেষণ করা অত্যান্ত গর্হিত কাজ? প্রতিটি সুস্থ-বিবেকবান মানুষ অধিকার রাখেন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে সচেতন সিদ্ধান্তের।

প্রিয় পাঠক, এ বিষয়ে আরো অনেক তথ্য উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা আমার আলোচনার মূল বিষয় নয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম “কোরআন পড়ে বুঝুন কি বলা হয়েছে তাতে।” সেইসাথে একটু ভেবে দেখুন আমরা যখন এসব কথা আরবীতে উচ্চারণের সুমধুর সুরে আল্লাহ্ তায়ালাকে শোনাই আমাদের এবাদতের সময়, তখন কি তিনি আনন্দের আতিশয্যে পুলকিত হয়ে ওঠেন নাকি বিমর্ষ হন? কে কাকে কোথায় কিভাবে বিয়ে করলো বা কারো বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটালো, সেটা কি আল্লাহকে শুনিয়ে নামাজ আদায় করা যুক্তিসঙ্গত? শুধু মাত্র আরবী বাচনেই আল্লাহ্ খুশী থাকবেন, তাকে যা ইচ্ছা তা শোনাবার পরও? এভাবেই চলেছে দুনিয়া। এভাবেই চলবে আরো।

কিন্তু কেউ মনে রাখবে না বেচারা যায়দের কথা, যার স্ত্রীকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে ছিনতাই করা হয়েছিলো বাবার লালসার তৃষ্ণা মেটাতে। বেচারা যায়দ দুঃখে, কষ্টে, বিমর্ষ বেদনায় দূরে সরে গেছে নিরবে, এটাই বুঝি ইসলামী হাকিকত! তবে  এ কাজটি যদি আজকের বিশ্বে সংঘটিত হয়, তাহলে সে সব বাবাদের নিশ্চিত পুরষ্কার হবে কয়েদিখানা আর বেত্রাঘাত। সেই সাথে থাকবে অকথ্য ভাষায় গালাগালি এবং অভিশাপ। কোরআন বুঝে পড়বার চেয়ে কোরআন পড়ে বোঝার প্রয়োজনীয়তা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, কোরআন পড়ে বুঝি কি বলা হয়েছে তাতে।

নবীজির নারী প্রীতির কথা আমরা জেনেছি অনেক কিতাবের পাতায় আর হাদীসের স্তরে স্তরে। বিশেষতঃ তিনটি জিনিস ছিল তার অতি প্রিয়। সুগন্ধি, দুম্বার ঘাড়ের অংশ এবং অন্যটি নারী। এটা এতোটাই প্রিয় ছিল তার যে তিনি অনেক নারীর সঙ্গসুখ গ্রহণ করেছেন একাধারে। সূরা আহযাবে একটি চমৎকার আয়াত রয়েছে যা চম্কে দেওয়ার মত। তাতে বলা হয়েছে- এরপর আপনার জন্য কোন নারী হালাল নয় এবং আপনার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও হালাল নয়। যদিও তাদের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে আপনার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপার স্বতন্ত্র। আল্লাহ্ সব বিষয়ের উপর সজাগ দৃষ্টি রাখেন। (সূরা আহযাব ৫২ আয়াত)।

আল্লাহ্ তায়ালা অনন্ত অসীম ও মহা পবিত্র। অথচ তাঁর নবীর এহেন নারী প্রীতি বা নারীর প্রতি দুর্বলতা কিভাবে পবিত্রতার সামিল হতে পারে তা বোধগম্য নয়। উল্লেখিত আয়াতে সুস্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে- এরপর আপনার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য কোন নারী সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করলেও তা আপনার জন্য হালাল নয়। বোধকরি আল্লাহ্ হয়তো একটু সাবধান হতে বলেছেন নবীকে তার নারী প্রীতি বা লালসার লাগাম টানার জন্য।

দুর্ভাগ্যক্রমে, আমরা এইসব আয়াতসমূহ উচ্চারণ করে আল্লাহর নেয়ামত হাসীল করার চেষ্টা করি, করে আসছি বহুদিন থেকে। অথচ কখনো ভেবে দেখিনাই কতটুকু যুক্তি সংগত এইসব আয়াতের উচ্চারণ তাঁর রহমত অর্জনের প্রক্রিয়ায়। বোধকরি এখনই এসব বিশ্লেষণের সময় এসেছে। এখনই সময় কোরআন পড়ে বোঝার, কি লেখা রয়েছে তাতে। আর তা দিয়ে কোন আমল নামার পাহাড় গড়ছি আমরা।

মজার ব্যাপার হলো এই যে, আমরা যখন নামাযে দাঁড়িয়ে এসব আয়াত উচ্চারণ করি তখন কি মনে হয় আল্লাহ্ তাতে পরিতৃপ্ত হন? মোটেও না।

আরও পড়ুন: বণী ইস্রাইল পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত জাতি

This Post Has 4 Comments

Leave a Reply