You are currently viewing বেহেশতী বিলাস ও স্বপ্নের হুরীরা

বেহেশতী বিলাস ও স্বপ্নের হুরীরা

  • Post author:
  • Post last modified:June 1, 2021

বেহেশতে যাবার বাসনা মানব জীবনের সবচেয়ে প্রধানতম আকাঙ্খা। এমন কেউ নেই যে বেহেশতে যাওয়ার পথ অন্নেষণ করে না। মনুষ্য জন্মের পর অবধারিত পরিণতি হলো মৃত্যু। আর মৃত্যু পরবর্ত্তী জীবনের দু’টি পথ খোলা। তার একটি বেহেশতের প্রাঙ্গন অন্যটি দোযখের অনলে যাবজ্জীবন। স্বভাবতই আমরা সবাই সেই বেহেশতী জীবন লাভের আশায় পথ চলি, খুঁজি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ভাল বীজ রোপন করলে যেমন ভাল ফসল আশা করা যায়, তেমনি জীবনে ভাল কাজের ফল যে ভাল হবে তাতে সবাই নিশ্চিত। তবে বেহেশতে যাওয়ার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

কারণ, বেহেশত আল্লাহর অধিকারভুক্ত জায়গা। তিনি কাকে সেখানে যাবার অধিকার দেবেন সেটা একমাত্র তিনিই জানেন। অথচ আমাদের ধর্মব্যবসায়ী আলেম-জালেমের কথায় মনে হয় যেন তাদের দেওয়া হয়েছে বেহেশতে যাবার প্রবেশ পত্র। তাদের বক্তৃতা-বিবৃত্তিতে মনে হয় আল্লাহ যেন তাদের কথায় ওঠেন আর বসেন। তাদের ওয়াজের ফজিলতে বেহেশতের অনেক টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাদের কথায় কখনো নামাজ হয় বেহেশতের চাবি, কখনো বা মা-বাবার দোয়া হয় বেহেশতে প্রবেশের প্রথম শর্ত। আবার কেউ কেউ জেহাদের উম্মাদনা জাগিয়ে তুলে শহীদ হওয়ার তাবীজ দেন অবাধে বেহেশতে প্রবেশের।

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে হত্যা করে জীবন নাশের ক্ষিপ্ত হিংস্রতায় যারা রক্তে হাত রাঙায়, তারা নাকি বেহেশতে প্রবেশ করবে আল্লাহর সাথে করমর্দনের অভিলাষে। অবশ্য কেউ বলেন না আল্লাহর সাথে করমর্দনের কথা, বলেন বেহেশতে প্রবেশের কথা। আর তা হবে আত্নঘাতি যুদ্ধে প্রাণনাশের পরিবর্তে কিংবা যুদ্ধে নিহত হওয়ার কারণে। মাশাআল্লাহ্‌!

এই সস্তা পথ অবলম্বনে অনেক তরুন ইতিমধ্যে জীবনকে দিয়েছে বিলিয়ে, তবে তা দিয়ে বেহেশতের দরজায় পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। যেসব পন্ডিতসম ব্যক্তিরা এভাবে তরুণ সমাজকে প্রভাবিত করে ধ্বংস-যজ্ঞ চালান তারাই কি কোনদিন পৌঁছাতে পারবেন বেহেশতের কিনারায়? পাড়ার সেই গণি পাগলও বলে দিতে পারে এটা অবাস্তব বা পৌরাণিকসম কেচ্ছা-কাহিনী।

আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর স্বীয় রহমত আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ। ধ্বংস-যজ্ঞতায় তাঁর কোন সম্পৃক্ততা নেই। তিনি জীবনদানকারী ও মহাপবিত্র। প্রাণ হরণের রক্তিম লীলায় কালি মূর্ত্তির অভিলাষ পূর্ণ হয় বটে, কিন্তু আল্লাহ্‌ তায়ালার কিন্ঞ্চিত আগ্রহ নেই সেখানে। তাঁর আগ্রহ যেন তাঁর সৃষ্টি ছুটে আসে তাঁর দরবারে এবাদতের সমর্পিত অন্তরে। তারবারির ধারালো অস্ত্রের ঝংকারে নয়।

বলছিলাম বেহেশতী বিলাসের কথা। অর্থাৎ কোরআনের বেহেশতি বর্ণনায় চিত্রটি একটু খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম। তাই সময় নষ্ট না করে আসুন দেখা যাক কি বলে সেখানে। কি রয়েছে বেহেশতে? কারা যাবে সেখানে? কি করবে তারা সেখানে? সূরা আন-নাবা, ৭৮: ৩১-৩৬-

إِنَّ لِلْمُتَّقِينَ مَفَازًا (٣١) حَدَآئِقَ وَأَعْنَـٰبًا (٣٢) وَكَوَاعِبَ أَتْرَابًا (٣٣) وَكَأْسًا دِهَاقًا (٣٤) لَّا يَسْمَعُونَ فِيهَا لَغْوًا وَلَا كِذَّٰبًا (٣٥) جَزَآءً مِّن رَّبِّكَ عَطَآءً حِسَابًا (٣٦) 

বাংলা অনুবাদঃ আয়াতের প্রথম প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায় সহজেই। সেখানে বলা হয়েছে— “মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সাফল্য, বাগানসমূহ ও আঙ্গুরসমূহ। সমবয়স্কা পূর্ণ যৌবনা তরুনী, আর পরিপূর্ণ পানপাত্র। সেখানে তারা অসার ও মিথ্যা বাক্যলাপ শুনবে না; এই প্রতিদান যথোচিত পুরস্কার আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে, যিনি প্রতিপালক আকাশমন্ডলি, পৃথিবী ও এর অন্তবর্ত্তী সমস্ত কিছুর, যিনি দয়াময়। তাঁর সাথে কথা বলার কোন অধিকার পাবে না তারা।”

উল্লেখিত কথাগুলি একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় “সেখানে রয়েছে- ক) বাগান, আঙ্গুরসমূহ ও খ) সমবয়স্কাপূর্ণ যৌবনা তরুণী, আর গ) পরিপূর্ণ পানপাত্র। আর সবশেষে বলা হয়েছে যিনি প্রতিপালক, ঘ) তাঁর সাথে কথা বলার অধিকার পাবে না তারা।”

তবে কি ইসলামের দৃষ্টিতে বেহেশত হবে শুধুমাত্র পুরুষদের মনোরন্জ্ঞনের প্রাঙ্গণ, যেখানে নারী ভোগের লালসায় উম্মাদ হবে পশুসম মানুষেরা এক বিকৃত কোলাহলে?

পূর্ণ যৌবনা তরুণী আর পরিপূর্ণ পানপাত্র কিসের সওগাত বয়ে আনে আমাদের কাছে? তবে কি বেহেশত মূলতঃ নারী ভোগের কাঙ্খিত আশ্রম? এই চিত্রটি কি আল্লাহ্‌ তায়ালার পবিত্রতাকে অপমাণিত করে না? বেহেশত কি তবে ভোগ আর লালসা চরিতার্থ করার জায়গা?

আমার সন্দেহ হয় এই আয়াত সমূহ আসলে আল্লাহ্‌ তায়ালার কথা হিসেবে গ্রহণ করতে। কারণ, নারী ভোগ আর পানপাত্র যদি এই পার্থিব জগতে হারাম বা নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তবে বেহেশতে যেখানে আল্লাহর পবিত্র আরশের অবস্থান সেখানে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় কিভাবে?

এ যেন পৃথিবীর বেশ্যালয়ের হুবহু চিত্র, যেখানে নারী আর পানপাত্র এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে এক অদ্ভুত সামিল।

সহীহ্‌ বোখারী শরীফ এ বেহেস্তের হুরী সম্পর্কে বলা হয়েছে এভাবে—বেহেশ্তবাসিনী কোন নারী (হুর) যদি দুনিয়ার দিকে উঁকি দিত তবে সমগ্র জগৎ তার রূপের ঝলকে ঝলমল করে উঠত এবং সুঘ্রাণে আমোদিত হত। বেহেশতবাসিনীদের (হুরদের) মাথায় ওড়নাও সমগ্র দুনিয়া ও তার সম্পদরাশি থেকে উত্তম। (হাদীস নং ২৫৯০, পৃষ্ঠা ৩৬৮, ৩৬৯, সিদ্দিকিয়া পাবলিকেশন, ঢাকা) দ্রষ্টব্য।

বেহেশত কি তবে বেশ্যালয়তুল্য আর আল্লাহ্‌ কি তাহলে তার প্রধান মালিক? এ কথা ভাবলেও তো কষ্ট লাগে। অথচ এই চিত্রটি প্রকৃতপক্ষে দৃশ্যমান।

আমার তো মনে হয় এই দুইয়ের মাঝে কোথায় যেন একটু ফারাক রয়ে গেছে। পরম করুণাময় মহিমান্নিত আল্লাহ্‌ তাঁর নিজ পবিত্রায় এমন কিছু বর্ণনা করেছেন তাঁর কালামে যা ভাবতেও কষ্ট হয়। পান-পাত্র আর যৌব্না রমণী জগতের বেশ্যাখানার প্রধান আকর্ষণ। আর এটি নিষিদ্ধ বা গর্হিত কাজ হিসেবে গণ্য। তাহলে আল্লাহ্‌ তায়ালা এহেন গর্হিত কাজের জন্য কিভাবে খুলে দেবেন বেহেশতের দরজা?

এটাই যদি হয়ে থাকে বেহেশতের নমুনা তাহলে আমার অন্তত আগ্রহ নেই সেখানে প্রবেশ করার। আমি প্রবেশ করতে চাই সেই বেহেশতে যেখানে ফেরেশতারা দিন-রাত আল্লাহর আরশের চর্তুপাশে এবাদতের মাঝে তাঁর গুন-গান করে চলেছে। আমারতো মনে হয় না হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও অন্যান্য নবীগণ বেহেশতের নারীদের (হুরীদের) সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে আছেন কিংবা তাদের পানপাত্রে চুমুক দিয়ে মাতাল হয়ে রয়েছেন। বরং তারা স্রষ্টার সান্নিধ্যে অবনত মস্তকে তাঁর গুনগান গেয়ে চলেছেন, চলবেন। শুধুমাত্র অসুস্থ মস্তিকের নগ্ন চিন্তার প্রকাশ পায় এইসব বেহেশতী চিত্রের কাল্পনিক বর্ণনায়।

ভাবতে লজ্জা করে যে, বড় বড় আলেমরা উপরদিকে চেয়ে আছেন বেহেশতের সেই বিলাসী জীবন কাটাবার আকাঙ্খায়। সেই সাথে তারা প্রতারিত করে চলেছেন সাধারণ ধর্মভীরু মানুষকে যারা নারী ভোগের আকাঙ্খায় বেহেশতে প্রবেশের দিন গুনছেন।

একটু ভেবে দেখুন তো— সূরা ‘আর রাহমান’ আমরা কতবার পড়েছি, কতবার শুনেছি এর মোহনীয় তেলাওয়াত। কিন্তু কখনও কি ভেবেছি এখানে এভাবে বর্ণিত হয়েছে বেহেশতী চিত্র? এইসব আয়াতের তেলাওয়াতে কতবার আমরা আল্লাহকে প্রলোভিত করেছি বেহেশতের বর্ণনায়। আরবীতে অনভিজ্ঞ থাকার কারণে আমাদের উচ্চারিত আয়াতগুলির মর্মার্থ নিজেরাই বুঝিনি কোনদিন।

মানুষ যখন তার মনুষত্ব হারায় তখন সে আচরণ করে নির্লজ্জের মতো। আর বুঝতে পারে না সে কি বলছে বা করছে। এইসব বেহেশতী কথামালা যেই সংযোজন করুন কোরআনের আয়াতে, তাতে যে স্রষ্টার কোন স্পর্শ ঘটে নাই তা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।

আল্লাহু আকবার! আল্লাহ্‌ মহান! কিভাবে তিনি বেশ্যালয় খুলবেন বেহেশতের বাগানে? দেখুন আরো একটি বর্ণনা—

 
فِيهِنَّ قَـٰصِرَٰتُ ٱلطَّرْفِ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ (٥٦) كَأَنَّهُنَّ ٱلْيَاقُوتُ وَٱلْمَرْجَانُ (٥٨) 

 সূরা আর রাহমান, ৫৫: ৫৬, ৫৮ আয়াত

বাংলা অনুবাদঃ সেখানে থাকবে আয়তনয়না তরুণীগণ, যাদের পূর্বে মানুষ অথবা জ্বিন স্পর্শ করেনি, প্রবাল ও পন্দরাগ সদৃশ এ সকল তরুণী। এছাড়াও রয়েছে—

فِيهِنَّ خَيْرَٰتٌ حِسَانٌ (٧٠) فَبِأَىِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (٧١) حُورٌ مَّقْصُورَٰتٌ فِى ٱلْخِيَامِ (٧٢) فَبِأَىِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (٧٣) لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَآنٌّ (٧٤) فَبِأَىِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (٧٥) مُتَّكِـِٔينَ عَلَىٰ رَفْرَفٍ خُضْرٍ وَعَبْقَرِىٍّ حِسَانٍ (٧٦) 

 সূরা আর রাহমান, ৫৫: ৭০-৭৬ আয়াত

বাংলা অনুবাদঃ সেখানে থাকবে সুশীলা ও সুন্দরী রমণীগণ। সুলোচনা ও তাঁবুতে অবস্থানকারিণী এ সকল রমণী। এদের ইতিপূর্বে মানুষ অথবা জ্বিন স্পর্শ করেনি। ওরা সুন্দর গালিচা বিছানো সবুজ চাদরের উপর হেলান দিয়ে বসবে।

শুধু তাই নয়, আরো বলা হয়েছে—

وَفُرُشٍ مَّرْفُوعَةٍ (٣٤) إِنَّآ أَنشَأْنَـٰهُنَّ إِنشَآءً (٣٥) فَجَعَلْنَـٰهُنَّ أَبْكَارًا (٣٦) عُرُبًا أَتْرَابًا (٣٧) 

 সূরা ওয়াক্কি-আহ ৫৬: ৩৪-৩৭ আয়াত

বাংলা অনুবাদঃ আরও থাকবে সম্ভ্রান্ত শয্যাশাঙ্গিনী, যাদের আমি সৃষ্টি করেছি বিশেষরূপে। যাদের করেছি চিরকুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্কা।

শয্যাশাঙ্গিনী চিরকুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্কা। এসবের তাড়নায় ইসলামী আলেম সমাজ দিবাস্বপ্নে মশগুল হয়ে চিৎকার করে গলা ফাটান প্রকাশ্যে। তাদের এ ডাকে সাড়া দিয়ে এ জগতেই অনুশীলন হচ্ছে অহরহ ধর্ষণ কর্মকান্ড। বেহেশতী বিলাস যেন শুধু ভোগ আর নারী লোলুপতায় সীমাবদ্ধ। ছোট শিশুরাও হচ্ছে সেইসব উন্মাদনার শিকার।

বেহেস্তের চিত্র সংক্রান্ত টীকা-তে এভাবে বর্ণিত হয়েছে বেহেশতী বিলাসের চিত্র। টীকাঃ তাঁবু মর্ম-সম্ভবতঃ সেই রকমের শিবির রাজ-রাজন্যদের জন্য যা ভ্রমণ স্থলে স্থাপন করা হয়। ভ্রমণক্ষেত্রগুলির স্থানে স্থানে তাঁবু স্থাপিত থাকবে, যেখানে হুরগন (পবিত্র, স্বর্গীয়া রমণীগন) তাঁদের ভোগ ও আনন্দ বর্ধনের উপকরণ স্বরূপ অবস্থান করবে।

চলুন ফিরে আসি শয্যাশঙ্গিনী, চিরকুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়স্কা স্বর্গীয় বিনোদন কারিণীদের প্রসঙ্গে। কি মনে হয় আপনার? কতজন শয্যাশঙ্গিনীর প্রত্যাশা করে চলেছেন আপনি? আদৌ কি আপনি সেই চিরকুমারী, সোহাগিনীর প্রত্যাশায় আল্লাহকে ডাকছেন? না কি তাঁর মহিমায় প্লাবিত হয়ে উৎলে উঠছে আপনার মন-প্রাণ, অন্তর? দেখুন আরেকটি চিত্রের বর্ণনা–

يَتَنَـٰزَعُونَ فِيهَا كَأْسًا لَّا لَغْوٌ فِيهَا وَلَا تَأْثِيمٌ (٢٣) ۞ وَيَطُوفُ عَلَيْهِمْ غِلْمَانٌ لَّهُمْ كَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَّكْنُونٌ (٢٤) وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ يَتَسَآءَلُونَ (٢٥) 

 সূরা আত্‌-তূর, ৫২: ২৩-২৫ আয়াত

বাংলা অনুবাদঃ সেখানে তারা (কৌতুক করে শারাবের পেয়ালা নিয়ে কাড়াকাড়িও করবে তাতে অনর্থক প্রলাপ নেই এবং পাপ কর্মও নেই। তাদের সেবায় নিয়োজিত সুরক্ষিত মোতিসদৃশ কিশোরেরা তাদের কাছে ঘোরাফেরা করবে। তারা একে অপরের মুখোমুখী হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

আমার তো বিশ্বাস হয় না আল্লাহর আসল কথা সমূহের প্রকাশ ঘটেছে এইসব আয়াতের ব্যাখ্যায়। এতে সুস্পষ্টতঃ বান্দার কাজ রয়েছে আল্লাহর চেয়ে বহুগুণ। তাই অনভিপ্রেত এই সব কাল্পনিক তথ্যের অবতারণা করেছেন তারা। নিজেদের মনগড়া স্বপ্নকে সাজিয়েছেন অনবদ্য এক অসত্য চিত্রের কারসাজিতে।

ইতিমধ্যে যদি আপনি সন্বিত ফিরে না পান, তাহলে পরবর্ত্তী আয়াতসমূহ হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন হয়ে পড়বে।

সূরা আত-তূর এর ২৩ ও ২৪ আয়াতগুলি একটু পড়ে দেখুন কিসের আলামত রয়েছে সেখানে। এখানে বলা হয়েছে— ২৩. সেখানে তারা একে অপরকে দেবে পানপাত্র যা পানে কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপকর্মেও লিপ্ত হবে না। ২৪. তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে কিশোরেরা, সুবক্ষিত মুক্তা সদৃশ ( ৫২: ২৩-২৪)। অন্য একটি অনুবাদে বলা হয়েছে— সেখানে তারা (কৌতুক করে শরাবের) পেয়ালা নিয়ে কাড়াকাড়িও করবে, তাতে অনর্থক প্রলাপ নেই এবং পাপ কর্মও নেই। অর্থাৎ শরাব খাবে তবে মাতাল হবে না। কি আশ্চর্য! যে কাজটি আমাদের এই পৃথিবীতে ঘৃনার যোগ্য সে কাজটি কিভাবে আমরা হালাল করেছি বেহেশতে? জগতে যা হারাম বা অশুচি তা বেহেশতে গিয়ে হালাল হয়ে যাবে?

এবার চলুন সুরক্ষিত মুক্তার মতো কিশোরদের প্রসঙ্গে। এত হুরী, সোহাগিনীসম শয্যাশঙ্গিনী থাকা সত্ত্বেও কিশোরদের কথা আসে কেন? তাহলে কি ধরে নিতে হবে সেখানে সমকামিতারও আয়োজন রয়েছে? এতো সুন্দরী হুরী থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রয়োজন সুন্দর কিশোরদের? তাও আবার বেহেশতের প্রাঙ্গণে? আমার বিশ্লেষণে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর শ্রদ্ধা আমার চিরকালের। তবে এভাবে আল্লাহর চিত্রকে ফুটিয়ে তোলা অসম্মানজনক এবং তা করেছেন আল্লাহর খাস বান্দারা। আল্লাহ্‌ হয়তো অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছেন তাঁর পশুবৎ বান্দাদের কর্মকান্ডের প্রতি। হয়তো অবাক হয়ে ভাবছেন কিভাবে জালেমরূপী আলেমরা তাঁর বেহেশতটিকে দুনিয়াবী কায়দায় ভোগের পান্থশালায় রূপান্তরিত করার পায়তারা করে চলেছে। সেইসাথে বিক্রয় করে চলেছে বেহেশতে ঢোকার প্রবেশ পত্র। আমার বাসাতেই আমি এই নিম্ন মনোবৃত্তির লোকদের প্রবেশ চিরকাল নিষিদ্ধ করে রাখবো। সাধারণ মানুষ হিসেবে এটি আমার চিন্তা চৈতন্যের পরিপন্থী। আর আল্লাহ্‌ পাক যিনি ধরা ছোঁয়ার উর্দ্ধে থেকে এহেন মনোবৃত্তি সম্পন্ন মানুষকে পশ্রয় দেবেন তাঁর প্রাঙ্গণে নারী, কিশোর ও শরাবের আয়োজনকে?

আল্লাহ্‌ তায়ালার চিন্তা ভাবনা মানুষের চেয়ে অনেক অনেক উর্দ্ধে। তাঁকে বুঝতে হলে তাঁর কাছে আসতে হয় বিনম্র শ্রদ্ধায় আর তাঁর প্রদর্শিত পথে। মেঝেতে শতবার মাথা ঠুকলেই তাঁর অন্তরের কথা জানা যায় না বা তাঁর সান্নিধ্য আদায় করা যায় না। বিশেষ দিনে, বিশেষ ক্ষণে কিংবা বিশেষ কোন জায়গায় তাঁকে খুঁজতে হয় না। কারণ, তিনি কোন বিশেষ ভঙ্গিমায় বিশেষ আহ্বানে সাড়া দেন না। তাঁর চোখ পৃথিবীর চর্তুদিকে ভ্রমণ করে যেন তিনি খুঁজে পান সত্যান্নষী মানুষ যারা তাঁকে অন্নেষণ করে চলেছে। আর তাদের অন্তরে তিনি নিজেকে প্রকাশ বা দৃশ্যমান করেন।

মানুষের অন্তরেই তাঁর নিবাস স্থাপনের আকাঙ্খা, মসজিদ-মন্দিরে নয়। মসজিদ-মন্দিরের সৌন্দর্য বর্ধনে মানুষের আত্নতৃপ্তি হয় বটে তবে তাতে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার কিছুই যায় আসে না। কারণ সেটি তাঁর আবাস নয়। আল্লাহ্‌ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর এবাদত করার জন্যে, তাঁর সাথে পথ চলার জন্যে। কিন্তু মানুষ তৈরী করেছে উপাসনালয়। আর আত্নতৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভেবেছে— আল্লাহ্‌ নিশ্চয় তাতে সন্তুষ্ট হবেন। মানুষের সম্পর্ক যখন আল্লাহর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তখন ওইসব উপাসনালয়ে আল্লাহ তায়ালা ভ্রমণ করবেন কোন্‌ দুঃখে?

একদিন এক দরিদ্র ব্যক্তি একটি সুন্দর মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। মসজিদের সৌন্দর্য তাকে আকৃষ্ট করে এবং সে শুক্রবারের জুম্মার নামাযটি সেখানে আদায় করার উদ্দেশ্যে প্রধান ফটকের কাছে যেতেই দু’জন লোক তার পথরোধ করে জিজ্ঞাসা করে জানতে চাইলো তার পরিচয়। লোকটি পরিচয় ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাকে বললো সে যেন কাছাকাছি অন্য কোন মসজিদের অন্নেষণ করে। কারণ হিসেবে ব্যক্তিদ্বয় তাকে (দরিদ্র ব্যক্তিটিকে) জানালো যে, সেই মসজিদটি শুধুমাত্র অভিজাত ব্যক্তিদের জন্য সুনির্দ্দিষ্ট।

অতঃপর মনোদুঃখে লোকটি তখন অন্য পথে পা বাড়ালো। তবে মনে মনে সে আল্লাহকে তার দুঃখটি জানাতে গিয়ে দু’ফোটা চোখের অশ্রুও ঝড়ালো। দুঃখে যখন পথ চলছে তখন তার অনেক প্রশ্ন জেগে ওঠে স্রষ্টার সকাশে। কি অপরাধ তার, কেনো তাকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হলো না?

ঠিক সেই মূহুর্তে আল্লাহ তাকে অভয় দিয়ে বললেন— দুঃখ করোনা, আমিও বিশটি বছর ধরে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করে আসছি কিন্তু তারা আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছেনা সেখানে। এই গল্পটির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে সত্যের প্রকৃত চিত্র।

বলছিলাম বেহেশতের বিলাসের কথা। বেহেশতের যে চিত্র বর্ণিত হয়েছে কোরআনের পাতায় পাতায় তা দেখে সহজেই অনুমান করা যায় সত্য-মিথ্যার তফাৎ। কিংবা এভাবে বলা যেতে পারে— বেহেশতের যে চিত্রের বর্ণনা রয়েছে কোরআনের পাতায় তা আল্লাহর কালাম নয়, বরং এটি তার বান্দার অদম্য কর্মপ্রয়াস আর উদ্ভট চিন্তার ফসল। এতে পবিত্রতার ছোঁয়া নেই। আছে লোভ-লিপ্সা আর ভোগ-বিলাসের অশ্লীল চিত্রকল্প।

নামাযে দাঁড়িয়ে কিংবা কোরআন খতমে কতবার তা আল্লাহকে পড়ে শুনিয়েছি আমরা, তার হিসেব তো কেউ রাখে নাই কখনও।

পবিত্র ইঞ্জিল শরীফে বেহেশতের যে চিত্রটি বর্ণিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ এর বিপরীত ও প্রাসঙ্গিক। তাতে বলা হয়েছে—

হযরত ইউহোন্নার বেহেস্ত দেখা

ইহার পর আমি বেহেশতের একটা দরজা খোলা দেখিতে পাইলাম। তূরীর আওয়াজের মত যাঁহার গলার আওয়াজ আগে আমি ‍শুনেয়াছিলাম, তিনি আমাকে বলিলেন, “তুমি এখানে উঠিয়া আসো। এই সমস্তের পরে যাহা কিছু অবশ্যই ঘটিতে যাইতেছে, তাহা আমি তোমাকে দেখাইব।”

আর তখনই আমি পাক-রূহের বশে বেহেশতে একটা সিংহাসন দেখিতে পাইলাম। আমি দেখিলাম, সেই সিংহাসনে একজন বসিয়া আছেন। তাঁহার চেহারা ঠিক সূর্যকান্ত ও সার্দ্দীয় মণির মত। সিংহাসনটার চারিদিকে একটা মেঘধনুক ছিল; উহা দেখিতে ঠিক একটা মরকত মণির মত। সেই সিংহাসনের চারিদিকে আরও চব্বিশটা সিংহাসন ছিল আর সেই সিংহাসনগুলিতে চব্বিশজন নেতা বসিয়া ছিলেন। তাঁহাদের পোষাক ছিল সাদা এবং তাঁহাদের মাথায় সোনার মুকুট ছিল। সেই সিংহাসন হইতে বিদ্যুৎ, ভয়ংকর আওয়াজ ও বাজের আওয়াজ বাহির হইতেছিল। সিংহাসনের সামনে সাতটি বাতি জ্বলিতেছিল। সেই বাতিগুলি খোদার সাতটি রূহ। সেই সিংহাসনের সামনে যেন স্ফটিকের মত পরিষ্কার একটা কাঁচের সমুদ্র ছিল।

সেই সিংহাসনগুলির মাঝখানের সিংহাসনটার চারিপাশে চারিজন জীবন্ত প্রাণী ছিলেন। তাঁহাদের সামনের ও পিছনের দিক চোখে ভরা ছিল। প্রথম জীবন্ত প্রাণীটির সিংহের মত, দ্বিতীয়টি বাছুরের মত, তৃতীয়টির মুখের চেহারা মানুষের মত এবং চতুর্থটির উড়ন্ত ঈগল পাখির মত। এই চারিজন জীবন্ত প্রাণীর প্রত্যেকের ছয়খানা করিয়া ডানা ছিল এবং সকল দিক চোখে ভরা ছিল। সেই প্রাণীরা রাত্রি-দিন এই কথাই বলিতেছিলেন—

“সর্বশক্তিমান প্রভু-খোদা, যিনি ছিলেন,
যিনি আছেন ও যিনি আসিতেছেন,
তিনি পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র।”

চির জীবন্ত প্রভু-খোদা, যিনি সিংহাসনে বসিয়া আছেন, এই জীবন্ত প্রাণীরা যখনই তাঁহাকে গৌরব, সম্মান ও ধন্যাবাদ জানান, তখন সেই চব্বিশজন নেতা সিংহাসনের অধিকারী, অর্থাৎ যিনি চিরকাল জীবিত আছেন, তাঁহাকে সেজদা করেন। এই নেতারা তখন সেই সিংহাসনের সামনে তাঁহাদের মুকুট খুলিয়া রাখিয়া বলেন, আমাদের প্রভু ও খোদা, তুমি গৌরব, সম্মান ও ক্ষমতা পাইবার যোগ্য, কারণ তুমিই সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিয়াছ। আর তোমারই ইচ্ছাতে সেই সমস্ত সৃষ্টি হইয়াছে এবং টিকিয়া আছে। (২৭শ খন্ডঃ প্রকাশিত কালাম ৪: ১-১১, ইঞ্জিল শরীফ)।

উল্লেখিত আয়াতসমূহে মহিমান্নিত খোদার বেহেশতী আরশের চিত্রটি পরিস্ফুষ্ট ও দৃশ্যমান। সেখানে যাদের অবস্থান তারা দিবারাত্রি খোদার গৌরব প্রশংসা করে চলেছেন। যারা সেখানে একদিন পৌঁছাবেন তারাও যোগ দিবেন সেই এবাদতের অন্তিম প্রবাহে। তাদের মাঝে নেই লালসা আর হুরী অন্নেষণের তাগিদ। তাদের মাঝে থাকবে না কোন শরাবপাত্র কিংবা রূপসী নারী ভোগের লিপ্সা। মহিমান্নিত আল্লাহ্‌ তায়ালার সান্নিধ্যে সবাই সেখানে মুশগুল থাকবেন আল্লাহর এবাদতে।

আমি জানি না কোন বেহেশতের প্রাঙ্গনে আপনি প্রবেশ করতে চান। ইসলামের হুরী বেষ্ঠিত বেশ্যালয়ে, নাকি আল্লাহর সত্যিকার অবস্থানে? সিদ্ধান্তটি আপনার বিবেচনায় ছেড়ে দিলাম।

আরও জানুন: আল্লাহর বিভাজন: আল্লাহ কয়ভাগে বিভক্ত? (২য় অংশ)

Leave a Reply