You are currently viewing কে এই ঈসা আল-মাসীহ্‌

কে এই ঈসা আল-মাসীহ্‌

  • Post author:
  • Post last modified:May 27, 2021

সা আল মাসীহ্‌ বিষয়ে অনেক আশ্চর্য কাহিনী চালু রয়েছে আমাদের ইতিহাস জুড়ে। বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন একজন বিশেষ নবী যাঁর জীবন ছিল আল্লাহর মাজেজায় পূর্ণ। আল্লাহর আশ্চর্যজনক ও মহিমাপূর্ণ কাজ তাঁর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছিল যা মানুষকে হতবাক করেছে। কিন্তু মানুষ শুধু আল্লাহর পরাক্রমশালী কাজ দেখেছে তাঁর জীবনে আর ব্যর্থ হয়েছে তাঁর আবির্ভাবের কারণ উদঘাটনে। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ তাঁকে শুধুমাত্র একজন বিশেষ নবী হিসেবেই চিহ্নিত করেছে অন্য কিছু নয়।

কিন্তু আমরা যদি কোরআনের কিছু আয়াতকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি তাহলে বুঝতে পারবো কোন্‌ অনভিপ্রেত অন্ধত্বে আমরা তাঁকে বুঝতে ব্যার্থ হয়েছি। তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন আমাদের পালনকর্তার কাছ থেকে এক নিদর্শন ও রহমত হিসেবে। তাঁকে কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে আল্লাহর কালাম বা কালেমাতুল্লাহ্‌। অর্থাৎ আল্লাহর বাক্য বা কালাম। আর কোন ব্যক্তি বা নবীকে এই নামে অভিষিক্ত করা হয় নাই কোন কিতাবে।

সুতরাং এটা অবধারিত সত্য যে, তাঁর সমকক্ষ আর কেহ নাই যিনি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন ও রহমত হিসেবে এসেছেন এই পৃথিবীতে। আরো একটি বিশেষ দিক রয়েছে তাঁর জীবনে আর তা হলো তাঁর জন্মের বারতা জানাতে আল্লাহ্‌ তাঁর ফেরেশতাকে পাঠিয়েছিলন। তা এতোই মর্যাদাপূর্ণ ছিল যে স্বয়ং ফেরেশতা মর্ত্যে নেমে এসেছিলেন তাঁর মা মরিয়মকে ব্যাপারটি জানাতে। আসুন দেখা যাক আয়াতে কি বলে। এখানে বলা হয়েছে- 

إِذْ قَالَتِ ٱلْمَلَـٰٓئِكَةُ يَـٰمَرْيَمُ إِنَّ ٱللَّهَ يُبَشِّرُكِ بِكَلِمَةٍ مِّنْهُ ٱسْمُهُ ٱلْمَسِيحُ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ وَجِيهًا فِى ٱلدُّنْيَا وَٱلْـَٔاخِرَةِ وَمِنَ ٱلْمُقَرَّبِينَ (٤٥)

বাংলা অনুবাদঃ “স্মরণ কর, যখন ফেরেশতারা বললঃ হে মারইয়াম! নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাকে একটি কালিমার ‍সুসংবাদ দিচ্ছেন তার নাম মাসীহ্‌ ঈসা ইবনু মারইয়াম। সে সম্মানিত ইহকালে ও পরকালে এবং সে আল্লাহর ঘনিষ্টদের মধ্যে একজ”, (সূরা আল-ইমরান, ৩: ৪৫ আয়াত)।

আমরা যদি একটু ভাল করে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো যে, আল্লাহ্‌ তাঁর পক্ষ থেকে আমাদেরকে একটি কালিমার সুসংবাদ দিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি মানুষ হিসেবে পাঠিয়েছে তাঁর কালিমাকে আমাদের মাঝে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমরা তাঁকে চিনতে ভুল করেছি। পৃথিবীতে আর কারো জন্মের বারতা কোনো ফেরেশতাকে দিয়ে পাঠানো হয় নাই । আর তা হবেও না কোনদিন। ঈসা আল-মাসীহ্‌ ইহকালে ও পরকালে আল্লাহর ঘনিষ্টদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি। আল্লাহর ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কথা সবারই জানা। এর পরবর্ত্তীতে হযরত মূসা (আঃ) এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনিও ছিলেন আল্লাহ্‌ তায়ালার অতি ঘনিষ্ট ব্যক্তি। এছাড়া হযরত দায়ূদ (আঃ) এর কথা জানা যায় যে, তিনি ছিলেন আল্লাহর অন্তরের কাছাকাছি ব্যক্তি। ঈসা আল-মাসীহ্‌ এমন একজন ব্যক্তি যার পক্ষে আল্লাহর ফেরেশতারা সাক্ষ্য বহন করতে পারে। এটি অত্যান্ত আশ্চর্যজনক বৈকি!

তাঁর নিজের বিষয়ে হযরত ঈসা বলেছেন যে, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছেন। আল ইমরান এর ৫০ আয়াতে বলা হয়েছে ঠিক এভাবে—

وَمُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَىَّ مِنَ ٱلتَّوْرَىٰةِ وَلِأُحِلَّ لَكُم بَعْضَ ٱلَّذِى حُرِّمَ عَلَيْكُمْ ۚ وَجِئْتُكُم بِـَٔايَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُونِ (٥٠)

বাংলা অনুবাদঃ “আর আমি এসেছি আমার সামনে তাওরাতে যা আছে  তার সত্যতার প্রমাণের জন্যে এবং তোমাদের জন্য কতিপয় জিনিস হালাল করার জন্য যা তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছিল। আর আমি তোমাদের কাছে এসেছি এক নিদর্শন নিয়ে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং অনুসরণ কর আমাকে।” (সূরা আল ইমরান, ৩: ৫০ আয়াত)।

ব্যাপারটি একটু বিশ্লেষণ করা যাক–

(ক) তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদর্শনঃ শুধু যে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছেন তা নয়, তিনি বলেছেন আমরা যেন আল্লাহকে ভয় করি ও তাঁকে অনুসরণ করি। কিন্তু এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, কেউ কোনদিন তাঁর এই কথাটি গুরুত্ব সহকারে আমল করে নাই। কেউ কোন মজলিশে এই কথাটি কখনো উচ্চারণ করেন নাই বা শিক্ষা দেন নাই। কিন্তু কেন? কেউ কি কখনো ভেবে দেখেছি ব্যাপারটি? কে কবে কোথায় কোনদিন এমন দৃঢ়তায় বলেছেন এ ধরায় নিজের আগমনের কারণটি? কেউই না। কারণ, তাঁর মতো কেউ আল্লাহর উদ্দেশ্য সাধনে আসেন নাই পৃথিবীতে।  

(খ) তিনি পাপহীন এক পবিত্র ব্যক্তিঃ তাঁর জন্মের পূর্বে ফেরেশতা যখন হযরত মারইয়ামের কাছে মসীহর জন্মের সুসংবাদটি এনেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন ঠিক এইভাবে—“আমি তো শুধু আপনার প্রতিপালকের প্রেরিত দূত, আপনাকে এক পবিত্র সন্তান দান করার জন্য উপস্থিত হয়েছি।” এখানে উল্লেখিত আরবী শব্দ “গুলামান জাকিয়া”-র অর্থ হলো – পবিত্র, পাপহীন, নিখুঁত, নির্মল ইত্যাদি।

বিষয়টি একটু ভেবে দেখবার প্রয়োজন আছে বৈ কি। আল্লাহ্‌ তাঁর দূত ফেরেশতাকে দিয়ে সুসংবাদ পাঠালেন মারইয়ামের কাছে একটি পবিত্র সন্তানের যখন সে ছিল সতী ও অবিবাহিত।

মারইয়াম ফেরেশতাকে দেখে ভয়ে আৎকে উঠলেও সেই সংবাদের উত্তরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- “কেমন করে আমার ছেলে হবে। কোনো মানুষ তো আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি অসতীত্ত নই?” (মারইয়াম ১৯: ২০ দ্রষ্টব্য)।

মারইয়ামের প্রশ্নটি অযৌক্তিক নয়। কিভাবে তার সন্তান হবে যদি না সে পুরুষের সংস্পর্শে আসে। সেই প্রশ্নের বিপরীতে ফেরেশতা তাকে বললেন।

قَالَ كَذَٰلِكِ قَالَ رَبُّكِ هُوَ عَلَىَّ هَيِّنٌ ۖ وَلِنَجْعَلَهُۥٓ ءَايَةً لِّلنَّاسِ وَرَحْمَةً مِّنَّا ۚ وَكَانَ أَمْرًا مَّقْضِيًّا (٢١)

বাংলা অনুবাদঃ “এভাবেই হবে, আপনার প্রতিপালক বলেছেনঃ এমন করা আমার পক্ষে খুবই সহজ। আমি তাকে মানুষের জন্য একটি নিদর্শন ও আমার পক্ষ থেকে রাহমাত স্বরূপ চাই। আর এটা তো একটি স্থিরকৃত বিষয়।” (সূরা মারইয়াম, ১৯: ২১ দ্রষ্টব্য)।

(গ) আল্লাহর রাহমাতের চিহ্ন স্বরূপঃ এটাতো একটি স্থিরকৃত ব্যাপার ছিল তাই তিনি ঈসা (আঃ) কে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন কোন পুরুষের স্পর্শ ছাড়াই যা একেবারেই অসম্ভব পৃথিবীর ইতিহাসে। আল্লাহ্‌ তাঁকে পাঠিয়েছেন এক নিদর্শন ও রাহমাতের চিহ্ন হিসেবে। এটা তাঁর ঐশ্বরিক পরিকল্পনার একটি নমূনা।

সূরা আল ইমরানের আয়াতে আল্লাহ্‌ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ নির্বাচন করেছেন আদমকে, নূহকে, ইবরাহীমের বংশধরকে এবং ইমরানের বংশধরকে বিশ্ববাসীর জন্য।” যদি আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের ও ইমরানের বংশধরকে বিশ্ববাসীর জন্য নির্বাচন করে থাকেন এই আয়াত অনুযায়ী, তবে কেনো আমরা তা অনুসরণ করি না?

আল্লাহ্‌ কবে পরিবর্তন করেছেন তাঁর এই ঘোষনার কথা? কেনো তবে আমরা কোরআনের এই আয়াতকে উপেক্ষা করে কুরাইশ বংশকে অনুসরণ করার পথ বেছে নিয়েছে? আমরা কি তাঁর অবাধ্য হচ্ছিনা? অমর্যাদা করছি না তাঁকে?

আল্লাহর বাক্যের কোন সাংঘর্ষিক বাক্য থাকতে পারে না। তাতে তাঁর অস্তিত্বকে অসম্মান করা হয়। ওষ্ঠাধরে তাঁর প্রশংসা করলেও আমরা অন্তরে তাঁকে অনেকভাবে খাটো করেছি যুগ যুগ ধরে, সেইসাথে পথভ্রষ্ট হয়েছি অসত্য দিক নির্দেশনায়।

এই ঈসা আল-মাসীহ্‌ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছে—আবু হুরাইরাহ্‌ বর্ণনা করেন যে, নবী বলেছেনঃ এমন কোন নবজাতক শিশুই জন্মগ্রহণ করে না যাকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় শয়তান স্পর্শ করে না। শয়তানের স্পর্শের কারণে নবজাতক শিশু চীৎকার করে কেঁদে ওঠে। তবে মারইয়াম ও তাঁর সন্তান ঈসা (আঃ) কে শয়তান স্পর্শ করতে পারেনি। এ হাদীস বর্ণনা করার পর আবু হুরাইরাহ্‌ বলেন, তোমরা ইচ্ছা করলে হাদীসের সমর্থনে কোরআনের আয়াত “ওয়া ইন্না উইযুহা বিকা ও যূররিআতাহা মিনাশ্‌ শাইতানির রাজীম”—আর আমি তাকে (মারইয়াম ও তার সন্তানকে বিতাড়িত শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি— পাঠ করো (সহীহ্‌ বোখারী শরীফ, সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশনস, ৪৫৫ পৃষ্ঠা, ৩১৮১ নং হাদীস) দ্রষ্টব্য।

(ঘ) ঈসা কিয়ামতের নিদর্শনঃ সূরা যুখরুক এর ৬১ আয়াতে দেখা যায় যে, তিনি হলেন কিয়ামতের নিদর্শন। স্পষ্টতঃ তা বলা হয়েছে এইভাবে—

وَإِنَّهُۥ لَعِلْمٌ لِّلسَّاعَةِ فَلَا تَمْتَرُنَّ بِهَا وَٱتَّبِعُونِ ۚ هَـٰذَا صِرَٰطٌ مُّسْتَقِيمٌ (٦١) وَلَا يَصُدَّنَّكُمُ ٱلشَّيْطَـٰنُ ۖ إِنَّهُۥ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ (٦٢) وَلَمَّا جَآءَ عِيسَىٰ بِٱلْبَيِّنَـٰتِ قَالَ قَدْ جِئْتُكُم بِٱلْحِكْمَةِ وَلِأُبَيِّنَ لَكُم بَعْضَ ٱلَّذِى تَخْتَلِفُونَ فِيهِ ۖ فَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ وَأَطِيعُونِ (٦٣)

বাংলা অনুবাদঃ আর তিনি তো কিয়ামতের নিদর্শন। সুতরাং, তোমরা তাতে সন্দেহ করো না এবং আমার অনুসরণ করো। এটাই সরল সঠিক পথ, শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই বিরত না রাখে, সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। যখন ঈসা স্পষ্ট নিদর্শনসহ আসলেন, তখন তিনি বললেনঃ আমি তো তোমাদের কাছে জ্ঞানগর্ভ বাণী নিয়ে এসেছি এবং তোমরা যে বিষয়ে মতভেদ করছ তা স্পষ্ট করে দেয়ার জন্য এসেছি। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর। (সূরা যুখরুক, ৪৩: ৬১- ৬৩ আয়াত) দ্রষ্টব্য।

যদি উল্লেখিত আয়াতসমূহে বলা হয়ে থাকে ঈসা কিয়ামতের নিদর্শন স্বরূপ তাহলে আমরা তাকে এত অবহেলা করি কেনো আমাদের আচরণে? কেনো আমরা তাঁর আনুগত্য প্রকাশে ব্যর্থ হই? আমরাতো কখনো শুনি না তাঁর বিষয়ে কোন কথা কোন ওয়াজ মাহফিলে। জানিনা তাঁর নাম উচ্চারণে ভীত হোন কিনা আমাদের সস্তা বিবৃত্তি দেওয়া পটু ইসলামী বক্তারা।

(ঙ) তিনি আল্লাহর আত্না বা পাক্‌ রূহঃ ঈসা যে আল্লাহর রূহ তার প্রমাণ পাওয়া যায় নিম্নেক্তো আয়াতে।

وَلَقَدْ ءَاتَيْنَا مُوسَى ٱلْكِتَـٰبَ وَقَفَّيْنَا مِنۢ بَعْدِهِۦ بِٱلرُّسُلِ ۖ وَءَاتَيْنَا عِيسَى ٱبْنَ مَرْيَمَ ٱلْبَيِّنَـٰتِ وَأَيَّدْنَـٰهُ بِرُوحِ ٱلْقُدُسِ ۗ أَفَكُلَّمَا جَآءَكُمْ رَسُولٌۢ بِمَا لَا تَهْوَىٰٓ أَنفُسُكُمُ ٱسْتَكْبَرْتُمْ فَفَرِيقًا كَذَّبْتُمْ وَفَرِيقًا تَقْتُلُونَ (٨٧) 

বাংলা অনুবাদঃ “নিশ্চয় আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রাসূলদের প্রেরণ করেছি, মারইয়ামের পুত্র ঈসাকে আমি স্পষ্ট মু’জিযা দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিশালী করেছি” (সূরা বাকারা, ২: ৮৭ আয়াত) দ্রষ্টব্য।

পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহ্‌ তায়ালা আর কাউকে তাঁর নিজ আত্নায় কিংবা নিজ রূহের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন নাই। নিঃসন্দেহে তিনি (ঈসা) সর্বোত্তম যিনি একাধারে আল্লাহর কালাম, আল্লাহর রূহের প্রকাশ। অর্থাৎ তিনি অদৃশ্য আল্লাহর হুবহু প্রকাশ। আল্লাহকে আমরা কেউ দেখতে পাই না কিন্তু বিশ্বাস করি তাঁর অস্তিত্বের কথা। তিনি ছিলেন, তিনি আছেন, তিনি থাকবেন চিরকাল।

তাঁর পৃথিবীতে আগমনের ব্যাপারটি অনেকে এভাবে ভেবে দেখেন নাই কখনো। তাই হয়তো বা তারা তাঁকে এক বিশেষ নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেই পরিতৃপ্ত হয়েছেন। আর তাঁর বিশেষত্ব বিশ্লেষণে ব্যর্থ হয়েছেন যে তিনি এসেছিলেন মানবজাতির মুক্তির কল্যাণে নিজেকে কোরবানীস্বরূপ উৎসর্গের জন্যে।

তিনি নিঁখুত ও পাপহীন ব্যক্তি হওয়ায় যোগ্যতা অর্জন করেছেন মানুষের পাপ ক্ষমার্থে স্বেচ্ছায় নিজেকে কুরবানী করার জন্য। যাতে আল্লাহ্‌ মানুষের অধার্মিকতার ‍প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে তাঁর কুরবানীকে গ্রহণ করতে পারেন। আর সেইসাথে মুক্ত করতে পারেন আমাদের সমস্ত অপরাধ, গোনাহসমূহ।

যদি তাঁর জন্ম হতো আমাদের মতোই পিতা-মাতার মিলনে, তাহলে তাঁর পবিত্রতা ক্ষুন্ন হতে পারতো। কারণ, প্রতিটি মানুষ মাত্রই ‍পাপের প্রকৃতির স্বভাবে বন্দী তাই তাঁকে বিশেষভাবে পাক রূহের মধ্যদিয়ে মানুষের মাঝে পাঠানো হয়েছিল শতভাগ মানুষ ও শতভাগ ঐশ্বরিকভাবে। পাক রূহের আবেশে তাঁকে মরিয়মের কাছে পাঠানো হয়েছিল। জিবরাইল ফেরেশতার কথানুযায়ী তা আমাদের কাছে প্রান্জ্ঞল। তিনি বলেছেন এভাবে হওয়ার কথাটি আল্লাহ্‌ স্বয়ং তাঁকে (জিবরাইল ফেরেশতা) দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমরা কিভাবে তা উপেক্ষা করতে পারি? তাঁকে বলা হয়েছে-“গুলামান জাকিয়া।” অর্থাৎ পাপহীন, নিখুঁত বা পবিত্র। আর তাঁর বিষয়ে বলা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর কাছ থেকে আসা রাহমাত ও নিদর্শন। ব্যাপারটি কি বিশ্লেষণের দাবি রাখে না? ফেরেশতার কথাটি কি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সমীচিন হবে? এজন্যেই আমাদের আজো মেঝেতে মাথা ঠুকতে হয় পাপের ক্ষমা ভিক্ষার অভিপ্রায়ে।

আমরা আল্লাহর দেওয়া পথকে উপেক্ষা করে নিজেদের বিধি-বিধানকে প্রতিষ্ঠা করে চলেছি। আর সময়ে-অসময়ে অতীব সমীহ সহকারে নিবেদিত হই অনিবর্চনীয় এক বন্দনার উপসংহারে। এটাই হয় আমাদের এবাদতের সামিল। আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কি কখনো আল্লাহর এবাদত করা সম্ভব? তাই বলছিলাম আমরা কি করে চলেছি নিজেরাও হয়তো জানি না। এই সেই ঈসা মসীহ্‌ যিনি বেহেশত থেকে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, আর ফিরে গিয়েছেন বেহেশতের সিংহাসনে। তাই তিনি আমাদের পক্ষে মৃত্যুকে বরণ করেছেন। পাপী মানুষকে গোনাহের কবজা থেকে মুক্ত করে আল্লাহর সাথে পূর্ণমিলন করার জন্যেই তাঁর এই আগমণ।

তাই মৃত্যু তাঁকে পরাজিত করতে পারে নাই। কারণ, তাঁর মৃত্যুর তিনদিনের দিন আবার তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন এবং সবার চোখের সামনে মেঘের রথে চড়ে আসমানে ওঠে গিয়েছেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি বারে বারে বলে গিয়েছিলেন যেভাবে তাঁর মৃত্যু হবে, যেভাবে তিনি জীবিত হয়ে উঠবেন এবং যথারীতি বেহেস্তে আরোহন করবেন। তবুও, আমাদের অজ্ঞনতার কারণে আমরা আজো বুঝে উঠতে পারি না এর প্রকৃত মর্মার্থ। কোরআনের আয়াতেও পাওয়া যায় এর সত্যতা।

إِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَىٰٓ إِنِّى مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَىَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَجَاعِلُ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوكَ فَوْقَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَـٰمَةِ ۖ ثُمَّ إِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (٥٥)

বাংলা অনুবাদঃ স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্‌ বললেনঃ হে ঈসা! অবশ্যই আমি তোমার মৃত্যু দান করবো, তোমাকে আমার দিকে তুলে নিব এবং যারা কুফরী করেছে তাদের থেকে তোমাকে পবিত্র ও মুক্ত করবো। আর যারা সত্যিকারভাবে তোমার অনুসরণ করবে কিয়ামত পর্যন্ত তাদের আমি কাফিরদের উপর স্থান দিব। অতঃপর আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের মধ্যে তার সমাধান করে দিব যে বিষয়ে তোমরা মতভেদ করতে। (সূরা আল ইমরান ৩: ৫৫ আয়াত দ্রষ্টব্য)।

উল্লেখ্য যে, আল্লাহ্‌ বলছেন, হে ঈসা! অবশ্যই আমি তোমার মৃত্যু দান করবো, তোমাকে আমার দিকে তুলে নিব…..ইত্যাদি। এখন আমরা কি বলতে পারি এই আয়াতে আল্লাহ্‌ মিথ্যা কথা বলেছেন? নাউজুবিল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌ যা বলেন তা অবশ্যই করেন বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে তাঁর উপর। তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন না বা যা বলেন তা করতে সক্ষম। সৃষ্টির সমস্ত কিছুই তাঁর হাতের মুঠোয়। তিনি যা বলেন তা করতে সক্ষম। আমরা তাঁর কথা বুঝতে না পারলে তো আর এটা ওটা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারি না। এটাতো গেলো আল্লাহ্‌ পাকের বর্ণনা।

এবার দেখা যাক ঈসা (আঃ) এর নিজের উক্তিটি কি বলে। সূরা মারইয়াম এর ৩৩, ৩৪ আয়াতে উল্লেখ রয়েছে—

وَٱلسَّلَـٰمُ عَلَىَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا (٣٣) ذَٰلِكَ عِيسَى ٱبْنُ مَرْيَمَ ۚ قَوْلَ ٱلْحَقِّ ٱلَّذِى فِيهِ يَمْتَرُونَ (٣٤)

বাংলা অনুবাদঃ “আমার উপর শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি জীবিত হয়ে পুনরুত্থিত হব। ইনিই মারইয়ামের পুত্র ঈসা। সত্য কথা যে ব্যাপারে লোকেরা সন্দেভাজন করে।” (সূরা মারইয়াম ১৯: ৩৪ আয়াত) দ্রষ্টব্য।

এখানে আরও একটি আয়াত সংযোজন না করলেই নয়। সেখানেও একই কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে ঠিক এইভাবে—

وَسَلَـٰمٌ عَلَيْهِ يَوْمَ وُلِدَ وَيَوْمَ يَمُوتُ وَيَوْمَ يُبْعَثُ حَيًّا (١٥)

বাংলা অনুবাদঃ “আর তার উপর শান্তি- যেদিন সে জন্মগ্রহণ করে, যেদিন তার মৃত্যু হবে এবং যেদিন সে জীবিত অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে।” (সূরা মারইয়াম, ১৯: ১৫ আয়াত)।

আপনার কি মনে হয় আল্লাহ্‌ বারে বারে তাঁর আয়াত সমূহে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন আমাদের না বোঝার জন্যে? নাকি আমরা তা না বোঝার ভান করে চলেছি অন্য স্রোতের টানে?

বস্তুতঃ, আমরা যখন আল্লাহর কালামকে উপেক্ষা করে নতুন উদ্ভাবনী পন্থায় নিজস্ব ধর্মের রীতি-নীতি অনুসরণ করি তাতে কিছু যায় আসেনা মহান রাব্বুল আলামীন এর। তবে তাঁর কালেমার প্রতি অবাধ্যতার মাঝে তাঁকে খুঁজে পাবার প্রত্যাশা করা অবিবেচনারই সামিল। অনেক আমলনামার পাহাড় গড়ে তুললেও পাপের বলয় বিদীর্ণ হবে না কোনদিন। বরং নম্রতায়, শ্রদ্ধাভরে যখন আমরা ফিরে আসি প্রভুর অন্তিম কৃপার দরবাবে, আর স্বীকার করি নিজের অবাধ্যতার কর্মকান্ড, তখন আমরা পেতে পারি তাঁর ক্ষমা আর ধার্মিকতার গ্রহণযোগ্যতা। এবং তা হতে পারে শুধুমাত্র ঈসা আল-মাসীহের উসিলায়। অন্য কোন পথে নয়। কারণ, আমাদের ধর্মীয় আমল নামা তাঁর কাছে শুধুমাত্র নোংড়া এক টুকরা নেকড়ার মতো, যদি না আমরা পেতে পারি ঈসা আল-মাসীহের আনুকল্য আর ক্ষমা।

একমাত্র তাঁর ক্রশীয় কর্মের নির্ভরতায় আমরা পেতে পারি অনন্ত জীবনের নিশ্চয়তা। এর বিকল্প কোনো পথ নেই আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের। বোধকরি এজন্যেই নবীজি মৃত্যু শয্যায় আয়েশার কোলে মাথা রেখে বারে বারে উপর পানে চেয়ে এ বিষয়টি উপলদ্ধি করতে পেরেছিলেন। আয়েশার কোলে মাথা রেখে উর্দ্ধপানে চেয়ে আর বারে বারে উচ্চারণ করেছিলেন ‘হে আল্লাহ্‌ আমার পাপ ক্ষমা করো এবং তোমার প্রিয়জনদের সান্নিধ্য আমায় দান করো।’বোধকরি মৃত্যু পরবর্ত্তী জীবনের চিন্তায় উৎকন্ঠিত হয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আল্লাহর অন্যতম সান্নিধ্য অর্জনকারী ব্যক্তিরা কারা এবং কারা তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম মৃত্যু পরবর্ত্তী বিচার থেকে। আমরাও হয়তো অপেক্ষা করে আছি মৃত্যু শয্যায় সেই উপলদ্ধির আশায়।

কোরআনের খন্ড খন্ড চিত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সহজ যে, ঈসা আল মাসীহ্‌ একমাত্র সত্য, পথ ও জীবন। কালেমার এই নিগুড়তত্ত্ব উদ্ধারে ব্যর্থ হলে আমরাও ব্যর্থ হবো আল্লাহর বেহেশত এ প্রবেশ করার অধিকার থেকে। মনে রাখা উচিত যে, বেহেশত আল্লাহ্‌ তায়ালার অধিকারভুক্ত। আর সে কারণেই তাঁর সিদ্ধান্ত বা অনুমতি ছাড়া কেহই পারবে না সেখানে প্রবেশ করতে। আল্লাহর প্রকাশিত কালাম উপেক্ষার পরিণতি হবে দোযখের অনলে অনন্তকালীন আত্নসমর্পণ।

যে সত্য শয়তানের প্ররোচনায় হরণ করা হয়েছিল হযরত আদম (আঃ) এর কাছে থেকে, সে সত্য হরণের কারণে আল্লাহর অবাধ্যতায় আদম ও হাওয়ার পতন হয়েছিল। সেই সত্যকে হযরত ঈসা আল-মাসীহর মধ্য দিয়ে পুনরুদ্ধারে আল্লাহর পথটিই হলো সত্য ও পথ। এই পথে চলার পরিসমাপ্তি হলো জীবন বা অনন্তজীবন। যাকে আমরা বলতে পারি রূহানী জীবন। সুতরাং আমাদের ভেবে দেখার সময় এখনই। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামী দিনের পরিনতির লক্ষ্যে পৌঁছাবার। ভেবে দেখতে হবে কোথায় যাচ্ছি আমরা মৃত্যু পরবর্ত্তীকালে। কোন্‌ উসিলায় আমাদের স্বম্ভবনা রয়েছে নাজাত লাভের। সেইসাথে রয়েছে বেহেশতের অসীম স্বম্ভবনা। আসুন, নিজের অন্তরকে আমরা অনুসন্ধান করে দেখি কি আছে সেখানে।

উপসংহারে আবারো জেনে নেই— কে এই ঈসা আল-মাসীহ্‌? তিনি ১) আল্লাহর পক্ষ থেকে নিদর্শন। ২) তিনি পাপহীন এক পবিত্র ব্যক্তি। ৩) আল্লাহর রাহমাতের চিহ্নস্বরূপ। ৪) কিয়ামতের নিদর্শন। ৫) আল্লাহর আত্না বা পাক্‌ রূহ। ৬) তিনিই একমাত্র পথ, সত্য ও জীবন। তিনিই সেই ব্যক্তি যার মধ্যে রয়েছে পাপ থেকে উদ্ধারের বা নাজাতের সম্পূর্ণ স্বম্ভবনা। তাঁকে অস্বীকার করা মানে আল্লাহ্‌ তায়ালাকে অস্বীকার করা। ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনিই অদৃশ্য ঈশ্বরত্বের হুবহু প্রকাশ। তামাম সৃষ্টির প্রথমজাত (কলসীয় ১: ১৫-১৬, ইঞ্জিল শরীফ)।

তাঁর বিষয়ে অবগত হওয়ার পর আমাদের দু’টি পথ খোলা রয়েছে। ক) তাঁর কাছে সমর্পিত হয়ে নাজাত প্রার্থনা করা সেইসাথে আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে এক আত্নায় পূর্ণমিলিত হওয়া। খ) তাঁকে অবজ্ঞা করা বা উপেক্ষা করতঃ আল্লাহর রহমতের বাইরে পথ চলা অর্থাৎ দোযখের পথে ধাবিত হওয়া।

এই দুইটির যে কোন একটি পথ আমরা বেছে নিতে পারি সে অধিকার আমাদের রয়েছে। তবে আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত আমাদের পৌঁছে দেবে অনন্ত জীবনের নির্দ্দিষ্ট ঠিকানায়, বেহেশত কিংবা দোযখ এই দু’টির একটিতে। আসুন, একটু চিন্তা করেই সে সিদ্ধান্তের পথে পা বাড়াই।

আরও পড়ুন: বণী ইস্রাইল পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানিত জাতি

This Post Has One Comment

Leave a Reply