ঈসা থোমাকে বলিলেন, আমিই পথ, সত্য ও জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেহই পিতার নিকটে যাইতে পারে না। (সুরা ইউহোন্না ১৪: ৬, ইঞ্জিল শরীফ, ৪র্থ খন্ড)। কথাটি ঈসা (আঃ) তাঁর এক সাহাবী থোমাকে বললেন তার এক প্রশ্নের উত্তরে।
আমাদের জীবনে তিনটি জিনিষ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলো পথ, সত্য আর জীবন। সত্য, আর জীবন (অনন্তজীবন) এর অন্নেষণে পথ চলি আমরা। এই চলার পথে বিভিন্ন দিক নির্দেশনায় অনেকেই হারিয়ে ফেলি সত্য পথের ঠিকানা। কোনটি সত্যের পথ? কোন পথে গেলে আমরা পেতে পারি স্রষ্টার অসীম রহমত বা আশীর্বাদের সম্ভার?
যুগ যুগ ধরে জীবনের পথ চলায় আমরা বিভ্রান্ত হয়েছি ধর্মীয় শিক্ষকের মিথ্যা ছলা-কলায় মার-প্যাঁচে পীর ফকির কিংবা তথাকথিত ওলামায়ে একরামরাও কি সঠিক পথ কিংবা সত্য আর জীবনের পথে চলেছেন? আসলে আমরা যখন আল্লাহর মহান নির্দেশের বিপরীতে পা ফেলি তখনই দিক্ নির্দেশনা হারিয়ে ফেলি। আর হাবুডুবু খাই মিথ্যার অথৈ সাগরে। কোনটি সত্য পথ? প্রশ্নটি সার্বজনিন। সবারই এক জিজ্ঞাসা কোনটি সত্য পথ? কোন পথের শেষ প্রান্তে রয়েছে অনন্তজীবনের নিশ্চয়তা?
আপনি হয়তো এতক্ষণে মাথায় টুপি দিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন দু’রাকাআয় নামায আদায়ের জন্য। কিংবা প্রস্তুত হচ্ছেন পীর-ফকিরের আস্তানা অনুসন্ধানের। কিন্তু আপনি কি জানেন ওগুলোর কোনোটিই নিতে পারে না আপনাকে আল্লাহর সান্নিধ্যে। আপনি হয়তো আত্নতৃপ্তি পেতে পারেন নিরবে ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ করার কারণে। কিন্তু জেনে রাখা ভাল যে, কোনো ধর্ম মানুষকে তাঁর স্রষ্টার অন্তরের কাছে পৌঁছে দিতে পারে না।
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর ঈশ্বরিক কালাম দিয়েছেন তাঁকে অনুসরণ করার। ধর্ম দেননি আত্নতৃপ্তি বোধ করার। যদি তিনি আমাদের ধর্ম দিয়ে পাঠাতেন তা অনুসরণ করার জন্যে, তাহলে একটিই ধর্ম থাকতো জগতে একাধিক নয়। কারণ, আল্লাহ্ একজনই এবং তিনি আমাদের এবাদত গ্রহণের প্রত্যাশায় রয়েছেন। আমরা তাঁকে ধর্মের কোলাহলে হারিয়ে ফেলেছি তাঁর সেই অবধারিত পথটি উদ্ঘাটন করার আগে। বিধিবদ্ধ নিয়ম-কানুনে, সুদৃশ্য ধর্মশালায় তাঁকে স্মরণ করে কতবার আমরা পশ্চিমমুখি হয়েছি আমরা। আমাদের ধারণা হয়তো তিনি পশ্চিম দিগন্তে উঁকি দেবেন। কেনো ভেবেছি সে কথা? কে বলেছে এই অভিনব পন্হাটি? পশ্চিম দিকে মুখ করে দাঁড়ালেই কি পথ খুঁজে পাওয়া যায়?
একদিন এক সাধু ব্যক্তি অনেক দূরের পথ পায়ে হেঁটে ক্লান্ত আর অবসন্নতায় মাঝ রাতে এসে পৌঁছালেন শহরের একটি সুদৃশ্য মসজিদের কাছে। তার কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় তিনি মসজিদের ঠান্ডা মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। কিন্তু ভোর বেলায় কিছু লোক মসজিদে ফজরের নামাজ পড়তে এসে অজানা এই আগন্তুককে চিৎকার করে ঘুম ভাঙালেন।
অতঃপর ধমকের সুরে বললেন- তোমার কি জ্ঞান-বুদ্ধি বলে কিছু নেই? পশ্চিম দিকে পা দিয়ে ঘুমিয়ে আছো? বেচারা আগন্তুক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো- কেনো ভাই, কি অপরাধ করেছি আমি? সমস্বরে সবাই তখন বললো- অপরাধ বোঝনা? পশ্চিমদিকে পা দিয়ে মসজিদের বারান্দায় ঘুমাচ্ছো তুমি। জানো না পশ্চিমদিকে আল্লাহর অবস্থান? উত্তরে আগন্তুকটি তখন বললো- ঠিক আছে তবে দয়া করে আমার পা দু’টি সেদিকে ঘুরিয়ে দেন যে দিকে আল্লাহর অবস্থান নেই।
এহেন উত্তরে কেউ লজ্জা পেয়েছিলো কিনা তা আমার জানা নেই। তবে একথা বলতে পারি যে, আল্লাহ্ তায়ালার অবস্থান সবদিকে। পূর্ব-পশ্চিম নিয়ে তাঁর মাথা-ব্যাথা নেই। মাথা-ব্যাথা হয় তা আমাদের অতি ধার্মিকতা ব্যক্তিদের।
আল্লাহ্ চান যেনো তাঁর বান্দারা তাঁর কাছে ছুটে আসে ক্লান্তি আর অবসন্নতা নিয়ে। আসে প্রত্যাশা আর নম্রতা নিয়ে। আমাদের অন্তরে কি সেটি ঘুরপাক খায়? মোটেও না। কারণ, আমরা ঈশ্বর তথা আল্লাহকে নিজের মনের কল্পিত কাহিনীতে নতুন রূপ দিয়ে চলেছি। আমাদের অন্তরের অর্গলটি উন্মুক্ত করি নাই তাঁর কালামের প্রতি।
ঈসা (আঃ) শুধুমাত্র বলেন নাই যে, তিনি একটি পথ, সত্য আর জীবন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, আমিই সত্য, পথ ও জীবন। অর্থাৎ তিনিই একমাত্র পথ সত্যের। তিনিই একমাত্র সত্য যা আমাদের গ্রহণ করা প্রয়োজন। তিনিই সেই জীবন যা অনন্তজীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
ঈসা (আঃ) কে যদি আমরা ধর্মীয় চক্ষু দিয়ে দেখি তাহলে বিভ্রান্ত হবো সবার মতোই। কিন্তু যদি বোঝার চেষ্টা করি কেনো তিনিই একমাত্র পথ তাহলে অন্নেষণ করতে হবে কে তিনি? কোন্ কতৃত্বের ভিত্তিতে তিনি একথা বলতে পারেন? তিনি পারেন কারণ তিনিই আল্লাহর কালিমা আল্লাহ্ তায়ালার রূহানী পুত্র। চম্কে উঠবেন না। মনে রাখবেন- আল্লাহর রূহের আবেশে কুমারী মানবীর গর্ভে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন এই পৃথিবীর মানুষের অমার্জনীয় অপরাধের মূল্য পরিশোধ করার জন্যে। (সূরা মারইয়া ১৯: ১৯)।
অথচ মানুষ তাঁকে চিনতে পারে নাই। তাঁর নিজ সম্প্রদায় বণী ইস্রাইল তাঁকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরাও আজো অনেকে ব্যর্থ হয়েছি তাঁকে চিনতে। যখন তিনি ঈসা (আঃ) বলেছেন আমা দ্বারা না আসিলে কেহই পিতার কাছে যাইতে পারে না। কথাটি অবধারিত সত্য হলেও বুঝতে কষ্ট হয় অনেকের। কারণ, কেহ যদি তাঁর কাছে না আসে সে যতই ঝাড়-ফুঁক করুক আর আল্লাহ্ আল্লাহ্ করুন তাতে কিছুই যাবে আসবে না মহান আল্লাহ্ তায়ালার। তিনি আল্লাহর নির্ধারিত পথ, তিনিই সত্য যে সত্য আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। তিনিই জীবন যে জীবন দেয় অনন্ত জীবনের ঠিকানা। তাঁকে উপেক্ষা করে শত কষ্টেও আমরা পেতে পারি না আল্লাহর অনুগ্রহ, রহমত।
ইন্জ্ঞিল শরীফের ইউহোন্না পুস্তকের ৫ অধ্যায়ের ৩৯ আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে- “আপনারা পাক-কিতাব খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন, কারণ আপনারা মনে করেন, তাহার দ্বারা অনন্ত জীবন পাইবেন। কিন্তু সেই কিতাব তো আমারই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। তবুও আপনারা জীবন পাইবার জন্য আমার নিকটে আসিতে চান না।”
আমরা শুধু মৌখিক বচনে ওষ্ঠাধরের অভিব্যক্তিকে মনোযোগ সহকারে তাঁর কথা পড়ে যাই অথচ তাঁর কাছে আসি না। কথাটি কি আসলে সত্য নয়? মুখে মুখে তাঁর কথা উচ্চারণ করা আর তাঁর কাছে নম্রতায় ফিরে আসা দু’টি পৃথক ব্যাপার। প্রথমটি আমরা রপ্ত করেছি ভালভাবেই কিন্তু দ্বিতীয়টি থেকে দূরে সরে রয়েছি আজো। তাঁর কথা উচ্চারণে কেউ অনন্তজীবন পায় না। তার কাছে সমর্পিত হলে থাকে সেই সম্ভবনা।
কোনো মৃত ব্যক্তির মাগফেরাত কামনা করে আমরা যখন বেহেশ্ত নিসেবের কথা বলি আর দু’হাত তুলে জান্নাতরে প্রত্যাশা করি হাজারো মানুষের সমাবেশে তখনও কি কেউ নিশ্চিত জানি সে লোক জান্নাতে কোনদিন পৌঁছাবে কিনা? কেউ পৌঁছাবে না সেখানে যদি না সেই ব্যক্তি নম্রতায় কোনদিন ফিরে আসে আল্লাহর মহিমান্নিত রূহানী পুত্রের পাদদেশে। একমাত্র তিনি পারেন আমাদের পাপের ক্ষমা করতে। যদি আমরা আমাদের পাপসমূহ (জানা-অজানা) স্বীকার করে তাঁর কাছে (ঈসা মসীহ্ এর কাছে) ফিরে আসি, গ্রহণ করি তাঁর প্রভুত্ব তৎক্ষণাত তিনি ক্ষমা করেন আমাদের সকল গোনাহ্।
যদি আপনি সত্য, পথ ও জীবনের অনুসন্ধানী হয়ে থাকেন, যদি ফিরে আসতে চান আল্লাহর দরবারে তাঁর ভালবাসার ছায়ায়, তবে আজকেই প্রার্থনা করুন নিরবে তাঁর কাছে। প্রাণ খুলে বলুন আপনার অন্তরের আকাঙ্খা। আর গ্রহণ করুন তাঁর মার্জনা আর অনন্তজীবনের নিশ্চয়তা। এতে ফিরে পাবেন অনাবিল শান্তি, আনন্দ আর জীবনের নতুন পথ চলার শক্তি। আল্লাহর অসীম রহমত আপনার মন-প্রাণকে ভরিয়ে তুলুক নতুন এর অনুপ্রেরণায়। আমিন।।
আরও পড়ুন: বাবা ও পুত্রবধুর বিবাহ: নবীজির হালালীকরণ বিষয়ক |