পৃথিবীর অনেক চমকপ্রদ বিষয়ে আমরা আশ্চর্য হই। কিন্তু যদি বলা হয় কোরআনের (বিধান) আয়াত অনুযায়ী নিজ কন্যার সাথে (বৈধভাবে সংগত হওয়াতে) কোন দোষ নেই, তাহলে কি আপনি আশ্চর্য হবেন না? দেখুন তবে কি বলে নিন্মেক্ত আয়াতের বর্ণনায়-
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَـٰتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَٰتُكُمْ وَعَمَّـٰتُكُمْ وَخَـٰلَـٰتُكُمْ وَبَنَاتُ ٱلْأَخِ وَبَنَاتُ ٱلْأُخْتِ وَأُمَّهَـٰتُكُمُ ٱلَّـٰتِىٓ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَٰتُكُم مِّنَ ٱلرَّضَـٰعَةِ وَأُمَّهَـٰتُ نِسَآئِكُمْ وَرَبَـٰٓئِبُكُمُ ٱلَّـٰتِى فِى حُجُورِكُم مِّن نِّسَآئِكُمُ ٱلَّـٰتِى دَخَلْتُم بِهِنَّ فَإِن لَّمْ تَكُونُوا۟ دَخَلْتُم بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلَـٰٓئِلُ أَبْنَآئِكُمُ ٱلَّذِينَ مِنْ أَصْلَـٰبِكُمْ وَأَن تَجْمَعُوا۟ بَيْنَ ٱلْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَّحِيمًا (٢٣)
সূরা আন্-নিসা ৪: ২৩
বাংলা অনুবাদঃ তোমাদের জন্য অবৈধ করা হয়েছে তোমাদের মাতা (দাদী, নানী), তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভাতিজী, ভগিনী কন্যা, দুধমাতা, দুধবোন, শাশুড়ী, (দাদী শাশুড়ী, নানী-শাশুড়ী)। তোমাদের স্ত্রীদের পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত কন্যা যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, যদি তোমরা ঐ স্ত্রীদের সাথে মিলন করে থাক। যদি তাদের সাথে মিলন না করে থাক তাহলে কোন দোষ নেই। এবং তোমাদের জন্য অবৈধ করা হয়েছে তোমাদের ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী এবং দুই বোনকে এক সঙ্গে বিয়ে করা। তবে পূর্বে যা গত হয়েছে, তা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
এই আয়াতটি পড়লে অবাক হবার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। অবাক কেনো, এটি সন্দেহ করার যথেষ্ঠ কারণও রয়েছে একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের কাছে। ভেবে আশ্চর্য লাগে যে আল্লাহ তায়ালাকে সুনির্দ্ধারিতভাবে বলে দিতে হবে আল্লাহর বান্দারা কার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হবে বা হবেনা? আল্লাহর অন্ধ বান্দারা কি নিজেদেরকে বিবেকের কষ্টি পাথরে যাচাই করতে পারেনা কোন্টি বৈধ বা অবৈধ? আমারতো মনে হয় কোন পশুকেও দিতে হবে এহেন শিক্ষার তালিম।
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, ইসলামের অনুসারীরা ছিল অন্ধকার রাজ্যের অধিবাসী। নতুবা কেনো তাদের বলে দিতে হবে- তোমাদের জন্য অবৈধ করা হয়েছে তোমাদের মাতা (দাদী, নানী), তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন….।
একটু ভালোভাবে পড়ে দেখুন আবারও এখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে “তার পূর্ব স্বামীর ঔরসে তার উরসজাত কন্যা, যারা তোমাদের অভিভাবকত্বে আছে, তবে যদি তাদের কন্যাদের মাতার সঙ্গে সহবাস না হয়ে থাকে তাতে তোমাদের বৈধভাবে সংগত হওয়া) কোন দোষ নেই।
আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে চাইনা। আমি চাই আমরা নিজেরাই যেন এর ব্যাখ্যা উদ্ঘাটন করতে পারি। তবে এ কথা বলা শ্রেয় যে এটা আল্লাহর কথা হতে পারে না।
একটু মনোযোগসহকারে উপরের লাইনগুলো আরেকবার পড়ে দেখুন। এবার ভেবে দেখুন কাকে সতর্ক করা হচ্ছে এইসব অপকর্ম থেকে বিরত থাকার জন্যে। ঈমানদারগণকে, সাহাবীগণকে কিংবা কোরআন অনুসারীগণকে। কিন্তু কেন? এটাও কি বলে দিতে হয় মা, বোন, খালা ফুফু বা শাশুড়ীর সাথে কিভাবে আচরণ করতে হবে? ধর্মের বিধান দিয়ে কিংবা নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখতে হয়? নাকি মানুষ তার সচেতন মনেই স্থির করে নিতে পারে মা-বোনের সাথে কিভাবে আচরণ করতে হয়। সমস্যাটি অন্যদিকেও রয়ে গেছে একইভাবে। কারণ এই আয়াতটি যখন মনোযোগসহকারে কেরাত করে উচ্চারিত হয় আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে তখন কি মনে হয় না তাঁর (আল্লাহ তায়ালার) অন্তর বিষিয়ে ওঠে ক্ষোভে, দুঃখে, অপমানে?
এ কারণেই বলছিলাম কোরআন পড়ে বোঝা উচিৎ আমাদের কি বলা হয়েছে তাতে। আর কিভাবে তা প্রয়োগ করতে হয় ব্যক্তি জীবনে। পাক পবিত্র আল্লাহ তায়ালাকে কি শোনাচ্ছি আমরা খত্মে কোরআন ও এবাদতের মধ্য দিয়ে সেটাই বিবেচ্য।
এ বিষয়ে সহীহ বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা প্রণিধানযোগ্য। এখানে বলা হয়েছে- “হুররিমাত আলাইকুম উম্মাহাতুকুম”- তোমাদের জন্য বিবাহ করা হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা-। “আবদুল্লাহ ইবনে জাফর একই সময় একসাথে আলীর স্ত্রী ও কন্যাকে বিবাহ করেন। (তারা উভয়ে ছিল সৎ মাতা ও সৎ কন্যা) ইবনে সীরীন বলেন, তাতে দোষের কিছুই নেই। কিন্তু হাসান আল বসরী এ মত প্রথমতঃ প্রত্যাখান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বলেন যে, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু হাসান ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব একইরাতে দুই চাচাতো ভগ্নীকে বিবাহ করেন। জাবের ইবনে যায়েদ (উভয় ভগ্নীর মধ্যে সতীনের মনোভাবের কারণে) সম্পর্কচ্ছেদের আশংকায় তাকে মকরূহ্ মনে করেছেন, কিন্তু তা হারাম নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, “এতদ্বতী আর যত স্ত্রীলোক রয়েছে (উপরের আয়াতে উল্লেখিতগণ বাদে) তা তোমাদের জন্য বৈধ করে দেওয়া হয়েছে।”
একরামা ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন, যদি কেউ তার শালীর সাথে অবৈধ যৌন মিলন করে, তা হলে তার স্ত্রী তার জন্য হারাম হয়ে যায় না এবং ইয়াহইয়া কিন্দি থেকে বর্ণিত, তিনি শা’বী, আবু জাফর থেকে বর্ণনা করেছেন যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন বালকের সাথে সমকামিতায় লিপ্ত হয়, তবে ঐ বালকের মাতা তার জন্য হারাম হয়ে যায় (অর্থাৎ বিবাহ নাজায়েয হয়ে যায়)।
ইয়াহইয়া কোন বিখ্যাত ব্যক্তি নন। অন্য কেউ তার এ রেওয়াতের অনুসরণ করেননি। একরামা ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেছেন, কেউ যদি শাশুড়ীর সাথে অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হয়, তবে তার স্ত্রী হারাম হয় না।
এমরান ইবনে হোসায়েন, জাবের ইবনে যায়েদ আল হাসান এবং কয়েকজন ইরাকের লোক থেকে বর্ণিত যে, তার স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হয়ে যাবে। উপরোক্ত ব্যাপারে আবু হোরায়রাহ বলেন, স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ততক্ষণ হারাম হয় না, যতক্ষণ না কেউ তার স্ত্রীর মাতার (শাশুড়ীর) সাথে অবৈধ যৌন মিলনে লিপ্ত হয়। ইবনে মুসাইয়্যাব, ওরওয়াহ এবং যুহরী প্রমুখ এমতবস্থায় স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক রাখা বৈধ বলেছেন। (অর্থাৎ স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নাজায়েয হয়না)। যুহরী বলেন, আলী (রাঃ) বলেছেন, হারাম হয়ে যায় না। যুহরীর কথা মুরসাল (অর্থাৎ যুহরী হযরত আলী (রাঃ) থেকে শুনেননি।)
আল্লাহর বাণীঃ “এবং তোমাদের সৎ মেয়ে বা সপত্নী-কন্যা, যারা তোমার অভিভাবকত্বের অধীনে রয়েছে- ঐ স্ত্রীদের গর্ভজাত কন্যা, যাদের সাথে তোমাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস বলেন যে, দুখুল মাসিস এবং লিমাস শব্দশ্রয়ের প্রত্যেকটির অর্থ যৌন সঙ্গম এবং যে ব্যক্তি বলে যে, স্ত্রীর পৌত্রি (অর্থাৎ নাতনী) কে বিবাহ করা তদ্রুপ হারাম, যদ্রুপ স্বীয় কন্যাকে বিবাহ করা হারাম এবং এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) -এর ঐ বাণীকে সনদ হিসেবে পেশ করে থাকেন, যা তিনি রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) উম্মে হাবীবাকে বলেছেন- “আমার কাছে তোমাদের কন্যাদের এবং ভগ্নীদের প্রস্তাব পেশ করো না।” এবং এভাবে নাতীদের স্ত্রী এবং পুত্রবধু বিবাহের জন্য হারাম। (বুখারী শরীফ, হাদীস ৪৭৩৪, পৃষ্ঠা ৭১৭-৭১৮ দ্রষ্টব্য)।
কোরআন নিশ্চয় পড়ে তা বোঝা প্রয়োজন কিসের আলামত রয়েছে তাতে। তাহলে নিজের অস্তিত্বের অবস্থানটিও পরিস্কার হবে অত্যাধিক। আর জানা যাবে কি কথা বলা উচিত আমাদের আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে।
নিরবে একটু চিন্তা করে দেখুন তো কি বলা হয়েছে কোরআনের পাতায় পাতায়? মা, কন্যা, খালা, ফুফু, শাশুড়ী বিষয়ে এতসব ব্যাখ্যার প্রয়োজন কেনো? কারণ, তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় আল্লাহর বান্দাদের লালসা আর লিপ্সার এক বিকৃত চিত্র।
কোরআনের এই আয়াতসমূহ যদি বাংলায় উচ্চারণ করা হতো নামাযে দাঁড়িয়ে, তাহলে বোধকরি কেউ আর পরবর্ত্তীতে মসজিদে প্রবেশ করতো না। ধর্মের আবরণে ভন্ডামির এক নোংড়া চিত্র এখানে প্রকাশ পায়। অথচ কেউ কোনদিন থম্কে দাঁড়ায়নি এইসব আজগুবি আয়াতের উচ্চারণে। কারণ এর অর্থ তারা বোঝে না। যারা বোঝে তারা মিথ্যার বেসাতি করে বিধায় প্রকাশ করে না অকৃত্রিম সত্যতা।
আমার বলার প্রয়োজন ছিল তাই অবলীলায় বলেছি। আপনার তা জানা প্রয়োজন তাই আপনি জেনেছেন। এ সত্য জানার পরও যদি আপনি অন্ধের মতো আচরণ করেন, তাহলে সেই অন্ধত্বের কারণে আপনি অন্ধকারের অসীম গহ্বরে হারিয়ে যাবেন।
আর যদি অন্ধকার বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসতে পারেন নতুন দিনের আলোকিত পথে, তাহলে ভেবে-চিন্তে নিজের মননশীলতাকে জাগিয়ে তুলুন। আর নিজেকেই প্রশ্ন করুন কোন পথে চলেছেন আপনি? কি আছে এ পথের শেষ সীমানায়- জান্নাতুল ফেরদৌস নাকি জান্নাতুল জাহান্নাম?