এই অদ্ভুত ব্যাপারটির বিষয়ে ইসলাম বিশারদদের স্বীকারোক্তিঃ
সূ
য়ুতি তার ‘ইতকান’ পুস্তকের (১ম অধ্যায়, ১৩৭ পৃষ্ঠায়) মন্তব্য করেছেন যে, ওমরের এই ঘটনায় এ কথা স্পষ্ট যে, এই বচন পরিবর্তন করেও তা তেলাওয়াত করা যায়। সূয়ুতি এ কথাও তার পুস্তকের ১৪১, ১৪২ পৃষ্ঠায় বলেছেন, অনেক মনীষী ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ওসমানের কোরআন লেখা হয়েছে শুধুমাত্র একটি (Dialect) বচনে।
একইভাবে, তার পুস্তকের ১৭০ ও ১৭১ পৃষ্ঠায় সূয়ুতি বলেন যখন ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের সাথে ওসমানের সময়কালে কোরআনের এই ভিন্ন বচন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মারামারির উপক্রম হতো, তখন ওসমান একটি বিরোধের আশংকা থেকে তা মুক্ত রাখার জন্য একটি (Standardized) নির্ধারিত আদর্শে তেলাওয়াতের ব্যবস্থা করেন। তিনি পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিলেন যে, ইরাকী ও সিরীয়রা কোরআনের এই সাতটি বচনের বিষয়ে অসম্মত হয়েছিলেন।
এখন দেখা যাক ডাঃ সালাবী এ বিষয়ে কি বলেন। তার বই ‘The History of Islamic Law’ (পৃষ্ঠা ৪০, ৪১) তে বলেছেনঃ “ওসমান তার সময়কালে কোরআন তেলাওয়াতের ব্যাপারে নিজের নির্দ্ধারিত আদর্শ উচ্চারণের ব্যবস্থা করেন। পরর্ব্ত্তীতে ওসমানীয় যুগের অবসান হলে মুসলমানরা আবার সাতটি বচনে কোরআন তেলাওয়াতের সূচনা করেন যা পূর্বে প্রচলিত ছিল। প্রতিটি দেশ তাদের বিশিষ্ট তেলাওয়াতকারীদের উচ্চারণের উপর নির্ভর করা শুরু করলো তখন থেকে। জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করে তা নির্দ্ধারিত করা হলো। তখনকার বিখ্যাত তেলাওয়াতকারীরা ছিলেন নাফি, ইবন খাখির, আবু উমর, ইবন আমীর, আসিম, হামজা এবং কিসাই। মিসরীয়রা হাফাস এর তেলাওয়াতের অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিল যিনি তা শিখেছিলেন আসিমের কাছ থেকে। এই অবস্থাটা আসলে মুসলমানদের অনেকের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি করলো, বিশেষত যারা একটি সমাধান খুঁজছিলেন। এই অন্নেষনকারীদের একজন শেখ কিশ কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা তিনি তার বই ‘Legal Opinion’ (১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ১১৩, ১১৪) তে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
প্রশ্নটি ছিল– আমি শুনেছি একজন তেলাওয়াতকারী কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন, ‘ও, তুমি যে বিশ্বাস করবে এমনকি একজন ঈশ্বরহীন দূতকেও যে সুখবর এনেছিল। সাবধান হও।’ এর পরিবর্তে তিনি এটা পড়লেন, ‘তদন্ত কর’। আমি একটি পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাইলাম এই একই কথার ভিন্ন আয়াতের বিষয়ে।
মেশকাত শরীফে ইবন মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হুজুর (সাঃ) বলেন- কোরআন সাত বচনে নাজিল হয়েছে। প্রত্যেক আয়াতের একটি বাহির ও ভিতরের দিক রয়েছে এবং প্রত্যেক দিকেরই একটি সীমা আর প্রত্যেক সীমারই একটি অসংগতিস্থান রয়েছে।
উল্লেখিত হাদিস ও বিষয়ে বর্ণিত অন্যান্য হাদিস অর্থগতভাবে ‘মুতাওয়াতির’। আসলে হাদিসে বর্ণিত ‘কোরআন সাত বচনে নাজিল হয়েছে’ এর মর্ম ও ব্যাখ্যা দেওয়া কষ্টকর ও জটিল। এ বিষয়ে অনেক মতনৈক্য ও বিরোধপূর্ণ মতপার্থক্য রয়েছে। আল্লামা সূয়ুতি এ ব্যাপারে চল্লিশটি এবং আল্লামা ইবনুল আরাবী (রাঃ) পঁয়তাল্লিশটি অভিমত উল্লেখ করেছেন।
এ বিষয়ে শেখ কিশ্ এর উত্তর কিঞ্চিৎ প্রনিধানযোগ্য। তার মতে– এই তেলাওয়াতকারীর তেলাওয়াতে ‘তদন্ত কর’ শব্দটি হলো একটি সঠিক ও বিখ্যাত উচ্চারণ যা মানুষের কাছে দেওয়া হয়েছে। হামজা, কাসাই এবং কালাফ তা অনুসরণ করেছেন। এই তিনজনই ছিলেন ওই দশজনের অন্যতম যার উপর মুসলিম ইমানদারগন বিশ্বাস করেন সঠিক হিসেবে। কোরআনের কপিতে যারা এই ‘অন্নেষণকারী’ উল্লেখ করেছেন, তারা এখানে নেই। অথচ এই তেলাওয়াতটি অর্থাৎ ‘অন্নেষণকারী’ কথাটি হাফাসের উচ্চারণে সংযোজিত হয়েছে। হয়তো বা আরো অনেক কোরআনের আয়াত লেখা হয়েছে এইভাবে। একই ভঙ্গিতে, তবুও তা সংযোজনের ক্ষেত্রে সত্যতা প্রমাণের দাবি রাখে।
এসব বিবেচনা করে প্রশ্ন থেকেই যায়, কোন বচনে মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে কোরআন নাজিল হয়েছে? কোন্ বচনেই বা ওইসব (Tablets) ফলকগুলি লেখা ছিল যখন তা আল্লাহ্ তায়ালার কাছে ছিল? সেখানে কি এক বচনে কোরআন লেখা ছিল নাকি ছিল সাতটি বচনে? শেখ কিশ্ (এবং মহানবী) কি বলতে চেয়েছিলেন যখন বলেছেন সবকটি বচন ও সবকটির অর্থ সঠিক?
কেনই বা নবীজি (সাঃ) মৃত্যুর পূর্বে এ বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়ে যান নাই? কেনই বা কোরআন তার জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ আঙ্গিকে প্রকাশিত হয় নাই। কেনই বা জিব্রাইল (আঃ) সম্পূর্ণভাবে কোরআনটি নবীজির হাতে সমর্পণ করেন নাই? তাহলে তো সমস্ত জটিলতার অবসান হতে পারতো অনায়াসে। সেক্ষেত্রে দলাদলি আর হানাহানি থেকে অব্যাহতি পেত মুসলিম জাহান।
প্রসঙ্গক্রমে, একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা যেতে পারে। একদিন হযরত আলী (রাঃ) মসজিদে গিয়ে দেখেন এক ব্যক্তি মানুষের মাঝে ওয়াজ-নসিহত করছেন। লোকদের জিজ্ঞেস করলেন লোকটি কি করছে? উত্তরে তারা বললো সে ওয়াজ-নসিহত করছে। হযরত আলী (রাঃ) তাকে বললেন- সে ওয়াজ করছে না। প্রকৃতপক্ষে সে এটা বোঝাতে চাচ্ছে যে, ‘আমি অমুকের পুত্র অমুক। তোমরা চিনে রাখ’। একথা বলে তিনি লোকটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি নাসেক মানসুখ সম্পর্কে কি জান? সে বললো জ্বি-না। আলী (রাঃ) তাকে বললেন, মসজিদ থেকে বের হয়ে যাও, আর কখনো ওয়াজ করবেনা (তাফসিরে কুরতুবি ২: ৬২, মুফতী মহিউদ্দীন কাসেমী রচিত কুরআন ও তফসির অধ্যায়নের পূর্বকথা, পৃষ্ঠা ৪৫ দ্রষ্টব্য)।