You are currently viewing কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৯ম খণ্ড)

কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৯ম খণ্ড)

  • Post author:
  • Post last modified:June 18, 2023

বিভিন্ন বিবরণ, আয়াত হারিয়ে যাওয়া ও আয়াতের সংযোজন বিষয়ক

হয়তো বেশির ভাগ মুসলিম ভাইদের জানা নেই যে, আজকের কোরআন তাদের হাতে এসেছে হজরত ওসমানের কর্মপ্রয়াসে। মুসলিম গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসীরা (Orthodox Muslim) বলেন যে, ওসমানের এই কোরআনে আল্লাহর সব প্রত্যাদেশগুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই ধরনের লোকেরা তাদের বিশ্বাস স্থাপন করেন স্বমত-পোষক (Dogmatic) উপাদানগুলিতে। কিন্তু তাদের কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন বা প্রমাণের ভিত্তি নেই। অথচ প্রাচীনকালের মুসলিম (Scholars) মনীষীরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত নমনীয়। কারণ তারা জানেন যে, ওসমানের এই কোরআনের বিভিন্ন অংশের বিবরণ, আয়াত হারিয়ে যাওয়া, নতুন আয়াতের সংযোজন করা সত্যভ্রষ্টার দোষে দূষিত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আস্‌ সূয়ূতি-র কথা যিনি অত্যন্ত বিখ্যাত কোরআন (Commentators) তফসিরকারক হিসেবে পরিচিত বলেন- ইব্‌ম ওমর আল-খাতাব বলেছেনঃ “কেউ না বলুক যে সে সমস্ত কোরআন সংগ্রহ করেছে, কারণ, তিনি কীভাবে জানেন যে, এটাই সবটুকু কোরআন?” কোরআনের অনেক অংশ হারিয়ে গেছে (আস্‌ সূয়ূতি-এর আল্‌ ইতকান ফী উলুমি’ল কুরআন, ৩য় খণ্ড, ৭২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

আয়েশা (রাঃ), মুহাম্মদ (সাঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী বলেন, (যা সূয়ূতির লেখায় প্রকাশ পায় “মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবিতবস্থায় সূরা জুমা (Parties) অধ্যায়ে দুইশত আয়াত ছিল। কিন্তু যখন ওসমান তা সম্পাদনা করেন তখন তা শুধু তেয়াত্তরটি আয়াতে পরিণত হয়।

আস্‌ সূয়ুতি আরো বলেন উবায় ইব্‌ন কা’ব এর ব্যাপারে যিনি হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম। এই বিখ্যাত ব্যক্তি একজন বিশিষ্ট মুসলিম মনীষীকে জিজ্ঞেস করলেন, সূরা জুমা (Parties) তে কতগুলি আয়াত আছে? উত্তরে তিনি বলেছেন, তেয়াত্তরটি আয়াতের কথা। অথচ উবা তাঁকে বলেছেন যে, এটা ছিল প্রায় সূরা বাকারার সমান দীর্ঘ (প্রায় ২৮৬ টি আয়াত)।

ইতিহাস লেখক ড. মুসা-এল-মূসাউই (Dr.Mosa-El-Mosawy) তার আল সেয়া (El-Sheaa) গ্রন্থের ১৩১ পৃষ্ঠায় বেশ খোলামেলাভাবেই বলেছেন যে, যারা কোরআনে সত্য ভ্রষ্টতার আশ্রয় নিয়েছিল তারা ইসলামের বিভিন্ন দলের অংশ। তবে তাদের বেশিরভাগ এসেছিল (El-Sheaa Scholars) আল-সেয়ার মনীষীদের কাছ থেকে।

বস্তুত, কোরআনের সত্যভ্রষ্টতা এত বেশী প্রকাশ ঘটেছে যে তার সেই সত্যতা ঢাকতে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন যেন তা জনসমক্ষে প্রকাশ না হয়ে পড়ে। যদিও ড. মূসা-এল-মূসাউই তা অকপটে প্রকাশ করেছেন তবুও শুধু তার উপর নির্ভর না করে আমরা আরো কয়েকটি প্রমাণের কথা উল্লেখ করতে পারি।

ইতিমধ্যে আমরা ওসমানের নিজের সাক্ষ্য, উবা এবং আয়েশার কথা উল্লেখ করেছি যারা সবাই বলেছেন ওসমানের এই সংকলনের দুষ্টতার (Perversion) কথা। সেই একই ঘটনার অবতারণা দেখা যায় ইব্‌নে হাজম এর পুস্তক (৮খন্ড, অংশ ১১, পৃষ্ঠা ২৩৪-২৩৫) তে। হজরত জামাকসারী তার লেখা আল-কাশ-সাফ পুস্তক (৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫১৮ তে ও একই কথা বলেছেন।

উল্লিখিত ব্যক্তিরা তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে ইতিহাসের পাতায় প্রতিষ্ঠিত। তারা হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন চরিত রচনা করেছেন এবং তাদের লেখায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনেক বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা দান করে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাদের মন্তব্য নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো। তাহলে প্রশ্ন জাগে, ওসমান কি তবে আল্লাহর কালামের বিষয়ে নির্দ্ধিধায় মিথ্যাকে সত্য বলে চালাতে চেয়েছেন? তার কি সে ক্ষমতা রয়েছে? কে দিল তাকে এ ক্ষমতা?

আয়াতের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা

ইব্‌নে হাজম্‌ (Ibn Hagm) তার বইয়ের (৮ম খণ্ড, ২য় অংশ, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৩৬) এ সহজভাবে বলেছেন- “(Stoning) পাথরমারা ও (Breast Feeding) স্তন্যপান বিষয়ক আয়াতে (যা আয়েশার কাছে ছিল) যখন মুহাম্মদ (সাঃ) মারা যান এবং সবাই তার মৃতদেহ দাফনের কাজে ব্যস্ত ছিল, তখন এক গৃহপালিত জন্তু (ছাগল) তার ঘরে ঢুকে পড়ে এবং তার সংরক্ষিত কোরআনের আয়াতসমূহ (যা তার বিছানার নিচে ছিল) খেয়ে ফেলে। আয়েশা (রাঃ) নিজেই বলেছেন যে, তার মনে আছে যা তার সংরক্ষণে ছিল।

এছাড়াও, মুস্তাফা হুসাইন, যিনি আল-কাশ-সাফ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন তিনিও বলেছেন এ কথা। জামাক সারি-র রচিত আল কাশ সাফ এ উল্লেখ করেছেন তার বইয়ের ৩য় খণ্ডে, ৫১৮ পৃষ্ঠায়। তিনি বলেছেন এ বিষয়টি আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আবু বকর ও আয়েশা (রাঃ) সমভাবে জানতেন। এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে দারুল কুত্‌নী-র “আল-বাজার” এবং আল তাবারানী তে। ইব্‌নে ইসহাক এ কথা জেনেছেন আব্দুল্লার কাছ থেকে যিনি তা জেনেছেন আয়েশার কাছ থেকে।

আরো বেশ কিছু হারিয়ে যাওয়া আয়াত রয়েছে যা লিপিবদ্ধ করা হয় নাই।

আস্‌ সূয়ুতি তার “ইতকান” পুস্তকের ৩য় খণ্ড, ৭৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন- আবু ইউনূস এর কন্যা হামিদার তথ্য দিয়ে, যখন আমার বাবার বয়স আশি বছর, তখন তিনি আয়েশা (রাঃ) এর অনুলিপি পড়ছিলেন, আল্লাহ্‌ এবং তাঁর ফেরেশ্‌তারা (তার জন্য প্রার্থনা করেন) নবীর জন্য রহমত চাচ্ছিলেন। তোমরা যারা বিশ্বাস কর, তার জন্য রহমত প্রার্থনা কর। হামিদা বলেন, এটা ছিল ওসমানের কোরআনের আয়াত পরিবর্তনের আগের ঘটনা। ৭৪ পৃষ্ঠায় আমরা দেখতে পাই, আব্দুর রহমান ওয়াফ কে ওমর বলেন, তুমি কি আয়াতসমূহের মধ্যে ওই আয়াতটি পাওনাই যা আমরা পেয়েছি? যেখানে বলা হয়েছে “পরিশ্রম কর যেখাবে তুমি ইতিপূর্বে করেছো। আমরা এ আয়াতটি আর খুঁজে পাই না। আব্দুর রহমান ইব্‌নে ওয়াফ তাঁকে বলেন, এই আয়াতগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে কোরআন থেকে।

“আব্দুর রহমান ইব্‌নে ওয়াফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যিনি খলিফার জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন। একই পুস্তকের একই পৃষ্ঠায় আমরা দেখি যে, মাসলামা আল-আনসারি নবি সঙ্গীদের বলেন “আমাকে দুইটি সঠিক আয়াত দেখাও যা ওসমান সংগৃহীত কোরআনে স্থান পেয়েছে। তারা তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। মাসলামা বলেন, তোমরা যারা ঈমান এনেছ এবং হিজরত করেছো এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করেছ নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, এমনকি নিজেদের সম্পত্তি ত্যাগ করেছো তারা অর্জন করেছ সম্মান ও গৌরব। কারণ তোমরা সফলকাম।

এছাড়াও যারা তাকে এই কাজে সহায়তা করেছে, এবং তাদেরকে রক্ষা করেছে, তাদের প্রতি আল্লাহর কি বিচার অপেক্ষা করছে তা কেউ জানেনা। উল্লেখ্য যে, আমরা শুধু কতিপয় বিশিষ্ট সাহাবিদের সাক্ষ্য ও উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরেছি যাদের মর্যাদা অত্যন্ত বেশী, বিশেষত কোরআন ও হাদিসের ব্যাপারে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন- আলী (রাঃ), ওসমান (রাঃ), আবু বকর (রাঃ), আয়েশা (রাঃ) ইব্‌নে মাসুদ ও ইব্‌নে আব্বাস। কোরআনের বিষয়ে এদের চেয়ে বেশী কেউ ব্যাখ্যা করতে পারে না বা জানা নেই।

এবারে ‘ইতকান’ এর ১৮৪ পৃষ্ঠায় নজর দেওয়া যাক। এখানে মালিক বলেছেন যে, কোরআনের ৯ অধ্যায় (তাওবা) থেকে বেশ কিছু আয়াত বাদ দেওয়া হয়েছে। একথা বলা হয়েছে যে, এই সুরাটি সূরা বাক্বারার মতো ছিল। তার মানে হলো এই যে, এই সূরা থেকে ১৫৭ টি আয়াত বাদ দেওয়া হয়েছে। সূয়ুতি বলেন যে, এইসব আয়াতসমূহ মাসুদ এর কাছে ছিল। হযরত ওসমান তা তার কাছে থেকে চেয়ে নিয়েছেন এবং অগ্নিদগ্ধ করেছেন বর্তমান কোরআন সম্পাদনার সময়ে। শুধু কতিপয় আয়াতই নয়।

অনেকগুলি অধ্যায় ওসমান বাতিল করেছেন নিজের কোরআন থেকে। সূয়ুতি এবং অন্যান্য আয়াত বিশারদেরা বলেন যে, ইব্‌নে মাসুদ ও উবে দু’জনেরই অনুলিপি যা সূরা ‘হাফাদ‘ (Hafad) এবং ‘খাল’ (Khal) নামে পরিচিত তা সূরা ‘আস্‌র‘ (Asar) অধ্যায়ের পরে সন্নিবেশিত হয়েছে। সূয়ুতি ১৮৫ পৃষ্ঠায় বলেন হজরত আলী (রাঃ) ও জানেন সে কথা। ওমর ইব্‌নে আল-খাতাব সেজ্‌দায় গিয়ে এ সূরাগুলি পড়তেন। আস্‌ সূয়ুতি এসব তথ্য তার বইয়ের ১৮৫ পৃষ্ঠায় পরিপূর্ণ পরিসরে প্রকাশ করেছেন।

উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক- তাহলে কোরআনের কোন্‌টি সঠিক আর কোন্‌টি বেঠিক? এ উত্তর বোধকরি পাঠককে নিজেই বিবেচনা করে নির্দ্ধারন করে নিতে হবে। এভাবেই শুরু থেকে চলে আসছে চালাকি আর চতুরতার ইসলামি ইতিহাস। আর বোকা বানানো হচ্ছে কোমলমতি ইসলামি অনুসারীদের। নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে ইসলামি কারিগরেরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করে অন্ধকারের অন্তিম পথে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের। সূক্ষ্ম চিন্তা আর বিশ্লেষণে আমরা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হবো সত্যের সোপান। আসুন সেই প্রচেষ্টাকে কাজে লাগাই আর বের হয়ে আসি অন্ধকারের রাজত্ব থেকে। আমিন!!!


সকল অধ্যায় পড়ুন

  • কোরআন-আবির্ভাবের-ইতিহাস (৯ম খণ্ড)

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৯ম খণ্ড)

  • কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৮ম খণ্ড)

  • কোরআনের ইতিহাস

    কোরআনের আবির্ভাবের ইতিহাস: বিভিন্ন বিবরণ, আয়াত হারিয়ে যাওয়া ও আয়াতের সংযোজন বিষয়ক

  • কোরআন নাজিলের ইতিহাস

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস

  • কোরআনে জের, জবার, পেশ ইত্যাদির ব্যবহারের ইতিহাস

    কোরআনে জের জবার পেশ ইত্যাদির ব্যবহারের ইতিহাস

  • কোরআনের ইতিহাস

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (সপ্তম খণ্ড)

  • ইসলাম ও কোরআন

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (ষষ্ঠ খণ্ড)

  • Islam and the quran

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (পঞ্চম খণ্ড)

  • History of holy quran

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৪র্থ খণ্ড)

  • History of the holy quran

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (৩য় খণ্ড)

  • History of Quran

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (২য় খণ্ড)

  • কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস

    কোরআন আবির্ভাবের ইতিহাস (১ম খণ্ড)

Leave a Reply