অত্যান্ত গোঁড়ামীতে পূর্ণ কিছু লোক প্রায়ই অপবাদ দিয়ে বলেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দসকে পরিবর্তন করা হয়েছে এবং মুরতাদ বা কাফেররা তা করেছেন অত্যান্ত সুক্ষভাবে। এহেন এক পন্ডিত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হল- এটা কখন করা হয়েছে? কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার আগে না পরে? উত্তরে কিছুক্ষণ নিরব থেকে তিনি অন্য প্রসঙ্গ তুললেন । আবারও তাঁকে প্রশ্ন করা হলো- আপনি কি দেখাতে পারবেন সঠিক কিতাবটি, কিংবা ক্রটিযুক্ত কিতাবটি, সেই হুজুর ব্যক্তিটি পরবর্ত্তীতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি তা স্পষ্ট জানেন না, লোকমুখে শুনেছেন শুধু।
ব্যাপারটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযোগ যা সচরাচর আলোচিত বা উত্থাপিত হয়ে থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যারা এই অভিযোগ করেন তারা জানেন না কি দুঃসহ অন্ধকারে তাদের বসবাস। তারা এটাও জানেন না যে তাদের এই অযাচিত সমালোচনার জন্যে রয়েছে দুঃসংবাদ। কারণ, কোরআন শরীফের আয়াত অনুযায়ী আল্লাহ্ তায়ালা মুহাম্মদ (সাঃ) কে নির্দেশ দিয়েছেন- তিনি যদি কোন আয়াত বা নবীত্বের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে যেন আহলে কিতাবীদের কাছে যান যারা সেই কিতাবের (কিতাবুল মোকাদ্দস বা তাওরাত, জবুর, ইন্জ্বীল) অনুসারী। কিতাবটি যদি পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ্ কিভাবে তা নবীজিকে অনুসরণ করতে বললেন? এরশাদ হচ্ছে-
فَإِن كُنتَ فِى شَكٍّ مِّمَّآ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ فَسْـَٔلِ ٱلَّذِينَ يَقْرَءُونَ ٱلْكِتَـٰبَ مِن قَبْلِكَ ۚ لَقَدْ جَآءَكَ ٱلْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلْمُمْتَرِينَ (٩٤)
বাংলা অর্থ: “আমি তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি ওতে যদি তুমি সন্দিহান হও তবে তোমার পূর্বের গ্রন্থ যারা পাঠ করে তাদের জিজ্ঞাসা করবে”। (সূরা ইউনূস, ১০ঃ ৯৪ আয়াত)
এই আয়াতের মধ্যে দিয়ে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মুহাম্মদ (সাঃ) কে সন্দেহমুক্ত হতে আহ্লে কিতাবীদের কাছে যেতে বলেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এ কথাও বলেছেন যেন আহ্লে কিতাবের মর্যাদাকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয়।
এছাড়াও কোরআন শরীফে বলা হয়েছে-
۞ وَلَا تُجَـٰدِلُوٓا۟ أَهْلَ ٱلْكِتَـٰبِ إِلَّا بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ إِلَّا ٱلَّذِينَ ظَلَمُوا۟ مِنْهُمْ ۖ وَقُولُوٓا۟ ءَامَنَّا بِٱلَّذِىٓ أُنزِلَ إِلَيْنَا وَأُنزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَـٰهُنَا وَإِلَـٰهُكُمْ وَٰحِدٌ وَنَحْنُ لَهُۥ مُسْلِمُونَ (٤٦)
বাংলা অর্থ: “তোমরা গ্রন্থকারীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করবে না, কিন্তু সৌজন্যের সাথে- তবে যারা জালেম তাদের সাথে নয়। আর বল, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা আবতীর্ণ হয়েছে তাতে আমরা বিশ্বাস করি, এবং আমাদের উপাস্য তো একই এবং আমরা তাঁরই অনুগত” (সূরা আনকাবুত, ২৯ঃ ৪৬ আয়াত)।
এরপরেও কি আপনি বলবেন কিতাবুল মোকাদ্দস বা তাওরাত, জবুর, ইঞ্জিল পরিবর্তন করা হয়েছে? আর পরিবর্তন হয়ে থাকলে আল্লাহ্ তা জানলেন না? ভুল করেই কি তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে সেই কিতাবটি অনুসরণ করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন? বলেছেন- আমাদের উপাস্য তো একই এবং আমরা তাঁরই অনুগত।
এমন কোন আলেম ব্যক্তি কি জীবিত আছেন যিনি বলতে পারেন কোথায়, কোন জায়গাটিতে এর পরিবর্তন করা হয়েছে? আর আসল কিতাবটিই বা কোথায়? এ উত্তরটি যদি অজানা থাকে তাহলে কেন এতো গলদঘর্ম হচ্ছেন মিথ্যার কারসাজীতে?
এটা বুঝতে কারো বাকি থাকার কথা নয় যে, কেউ যদি বলে কিতাবটি পরিবর্তন করা হয়েছে বা পরিবর্ধন করা হয়েছে কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরে, তাহলে বলতে হবে যে, কোরআন তা সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, কোরআনকে পাঠানো হয়েছে এই কিতাবগুলি সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে। সূরা মায়িদা’র ৪৮ আয়াত একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ।
وَأَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلْكِتَـٰبَ بِٱلْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ ٱلْكِتَـٰبِ وَمُهَيْمِنًا ….(٤٨)
উচ্চারণঃ ওয়া আনযালনা ইলাইকাল কিতা-বা বিলহ্বাক্বক্বি মুছাদ্দিক্বাল লিমা-বাইনা ইয়াদাইহি মিনাল কিতা-বি ওয়া মুহাইমিনান…
বাংলা অর্থ: “তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব আবতীর্ণ করিয়াছি, ইহার পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংরক্ষণরূপে” (সূরা মায়দা, ৫ঃ ৪৮ আয়াত)।
এখানে দুইটি বিষয় উল্লেখ্যযোগ্য, তাহলো- কোরআনকে পাঠানো হয়েছে কিতাবুল মোকাদ্দসের সমর্থক ও সংরক্ষণরূপে। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমরা কি তার যথাযথ সমর্থক ও সংরক্ষণকারী? মোটেও না, শুধুমাত্র কিছু আয়াতের মৌখিক শব্দ উচ্চারণের খই ফোটালেই আল্লাহ্ তায়ালার বাধ্য হওয়া যায় না, বাধ্যতা প্রতীয়মান হয় কর্মপ্রয়োগে। অর্থাৎ সুচারুভাবে তা পালনের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহ্ তায়ালার প্রত্যাশা আমরা যেন তাঁর আয়াতের অনুসারী হই বাধ্যতায়। একই ধরণের শিক্ষা পাওয়া যায় সূরা আল-ইমরান এর আয়াতেও, তাতে বলা হয়েছে-
نَزَّلَ عَلَيْكَ ٱلْكِتَـٰبَ بِٱلْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْهِ وَأَنزَلَ ٱلتَّوْرَىٰةَ وَٱلْإِنجِيلَ (٣)
উচ্চারণঃ নাজ্জালা আলাইকাল কিতা-বা বিলহাক্বদ ক্বি মুছাদ্দিক্বল লিমা- বাইনা ইয়াদাইহি ওয়াআনয্বাল তাওরা-তা ওয়াল ইঞ্জিল।
বাংলা অর্থ: “তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি কিতাব (তাওরাত, ইঞ্জিল) অবতীর্ণ করেছেন, যা তার পূর্বের কিতাবের সমর্থক।” সূরা আল-ইমরান ৩ : ৩ আয়াত)। ইংরেজী অনুবাদে তা বলা হয়েছে ঠিক এভাবে- He has sent down upon you, [o Mahummad], the book in truth, confirming what was before it. And He revealed the Torah and the Gospel. অর্থাৎ তিনি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর প্রতি কিতাব (কোরআন) অবতীর্ণ হয়েছে কিতাবুল মোকাদ্দসের সমর্থক ও সংরক্ষক হিসেবে। অথচ আমরা এর সমর্থনের পরিবর্তে করি সমালোচনা।
আল্লাহর কিতাবের অনুসারী হতে হলে কিতাবী (কিতাব নির্ভর) হতে হয়, মাদ্রাসা নির্ভর বা কোন হুজুরের ফতোয়া নির্ভর নয়, কিন্তু আমাদের বিশ্বাসের প্রাঙ্গনে আজকাল চলছে কালামের নৈরাশ্য। কারণ, নামী-বেনামী হুজুরের কৌশলী ওয়াজের মারফতে মানুষ ঈমান থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে দলে দলে। হয়তো বা এই বিভ্রান্তির কারণেই বলা হয়েছে- “তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তাওরাত আন এবং পাঠ করো।”
কখনো কি শুনেছেন এই সব ওয়াজ নসিয়ত? না, কেউ শুনেন নাই কারণ, তা বলে নাই কেউ। বললে স্বপ্নভ্রষ্ট হবে ওয়াজকারী ব্যক্তির। “তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তাওরাত আন এবং পাঠ কর” (সূরা আল-ইমরান, ৩ঃ৯৩ আয়াত)। তাওরাতের বিষয়ে আরো বলা হয়েছে কোরআনের পাতায় পাতায়। একটু খতিয়ে দেখুন না কি বলে আয়াতটিতে।
إِنَّآ أَنزَلْنَا ٱلتَّوْرَىٰةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا ٱلنَّبِيُّونَ ٱلَّذِينَ أَسْلَمُوا۟ لِلَّذِينَ هَادُوا۟ وَٱلرَّبَّـٰنِيُّونَ وَٱلْأَحْبَارُ بِمَا ٱسْتُحْفِظُوا۟ مِن كِتَـٰبِ ٱللَّهِ وَكَانُوا۟ عَلَيْهِ شُهَدَآءَ ۚ فَلَا تَخْشَوُا۟ ٱلنَّاسَ وَٱخْشَوْنِ وَلَا تَشْتَرُوا۟ بِـَٔايَـٰتِى ثَمَنًا قَلِيلًا ۚ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْكَـٰفِرُونَ (٤٤)
উচ্চারণঃ ইন্না- আনয্বালনাত তাওরা-তা ফীহা- হুদাও ওয়া নূরুন ইয়াহ্বকুমু বিহান নাবিয়্যনাল লাযীনা আসলামূ লিল্লাযীনা হা-দূ ওয়া রাব্বা- নিয়্যূনা ওয়াল আহ্বা-রু বিমাস্ তুহফিজ্ব মিন কিতা- বিল্লা-হি ওয়া কা-নু আলাইহি ওয়াদা- আ, ফালা-হ্ তাথশাউন না-সা ওয়াখশাওনি ওয়ালা- তাশতারূ বিআ-য়া-তী ছামানান ক্বালীলান ; ওয়া মাল্লাম ইয়াহ্কুম বিমা- আনয্বালা-ও ফাউলা- ইকা হুমুল কা- ফিরুন।
বাংলা অর্থ: “নিশ্চয় তাওরাত অবতীর্ণ করিয়াছিলাম, ওতে ছিল পথ নির্দেশ ও আলো, নবীগণ যারা আল্লাহর অনুগত ছিল তারা ইহুদীদের তদনুসারে বিধান দিত, জ্ঞান-সাধক এবং পন্ডিতগণ ও তদনুসারে বিধান দিত, কারণ তাদের আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হয়েছিল এবং তারা ছিল ওর সাক্ষী। সুতরাং, মানুষকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় করো এবং আমার আয়াত নগণ্য মূল্যে বিক্রয় করো না। এবং আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না, তারাই অবিশ্বাসী (সূরা মায়িদা ৫ঃ ৪৪ আয়াত)।
এটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা যে, আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই অবিশ্বাসী, আহ্লে কিতাব যদি পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয়ে থাকে তাহলে কি আল্লাহ্ তায়ালা কষ্ট করে এতগুলো আয়াতের সতর্কবাণীতে তার প্রতি বাধ্যতার নির্দেশ দিয়েছেন?
আল্লাহর বাণী যাদের বুঝতে কষ্ট হয় তারাই ছেলে-মানুষী এই অপরিপক্ক অভিযোগ করেন অরণ্যে রোদনের মতো। আহ্লে কিতাবীরা অত্যান্ত গুরুত্ব সহকারে তাদের কিতাব সমূহকে সংরক্ষণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে, জাতিতে জাতিতে। আল্লাহ্ তায়ালা স্বয়ং এর রক্ষাকারী। কোরআন শরীফে এভাবেই তা স্পস্টত বলা হয়েছে- “আল্লাহর আদেশ কেউ পরিবর্তন করতে পারে না” (সূরা আনআম, ৬:৩৪ আয়াত)।
…..وَلَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَـٰتِ ٱللَّهِ ۚ …(٣٤)
অনেকে আবার একথা বলে থাকেন যে, তাওরাত, জবুর ও ইঞ্জিলে মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যাপারে বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও তারা রক্ষা করতে ব্যর্থ হলেন কেন?
নিচের আয়াতগুলো পড়ে আমাদের আরো গভীরভাবে তা উপলদ্ধি করা উচিত। কারণ এতে আল্লাহর কালামের গুরুত্বতা সম্পকে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে তাঁর বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই (সূরা কাহ্ফ ১৮ঃ ২৭ আয়াত)।
আরও বলা হয়েছে-
سُنَّةَ ٱللَّهِ ٱلَّتِى قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلُ ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ ٱللَّهِ تَبْدِيلًا(٢٣)
উচ্চারণঃ সুন্নাতাল্লা- হিল লাতী ক্বাদ্ খালাত্ মিন্ ক্বাব্লু; ওয়া লাণ্ তাজ্বিদা লিসুন্নাতিল্লা-হি তার্বদীলা।
বাংলা অর্থ: “এটিই আল্লাহ্ বিধান, প্রাচীনকাল হতে চলে আসছে; তুমি আল্লাহর এ বিধানে কোন পরিবর্তন পাবে না (সূরা ফাতাহ্, ৪৮ঃ ২৩ আয়াত)। তাহলে কিভাবে তা পরিবর্তিত হলো?
একটি প্রশ্ন সর্বদাই উথলে ওঠে আমার অন্তরে। আমি জানিনা অন্যদের মাঝে এর প্রতিক্রিয়া কতটুকু হবে। সূরা বাকারাহ্, ২: ১৩৬ আয়াতে বলা হয়েছে-
قُولُوٓا۟ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَمَآ أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَآ أُنزِلَ إِلَىٰٓ إِبْرَٰهِـۧمَ وَإِسْمَـٰعِيلَ وَإِسْحَـٰقَ وَيَعْقُوبَ وَٱلْأَسْبَاطِ وَمَآ أُوتِىَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَآ أُوتِىَ ٱلنَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُۥ مُسْلِمُونَ (١٣٦)
উচ্চারণঃ কূল-আ-মান্না-বিল্লা-হি-ওয়ামা-উনযি¦লা ইলাইনা-ওয়ামা-উনয্বিলা ইলা-ইব্রী-হীমা ওয়াইসা-ঈলা ওয়াইসহ্ব-কা ওয়াইয়া-কূবা ওয়াল আসবাত্বি ওয়ামা-উতিইয়া মূসা- ওয়াঈসা-ওয়ামা-ঊতিইয়ান নাবিয়্যূনা মির বাব্বিহিম, লা-নফাররিকু বাইনা আহ্বাদিন মিনহুম, ওয়ানাহনু লাহু মুসলিমূন।
বাংলা অর্থ: “তোমরা বল, আল্লাহ্তে ঈমান এনেছি এবং যা আমাদের প্রতি এবং ইব্রাহীম, ইস্মাইল, ইসহাক ও ইয়াকুব ও তাঁর বংশবলীর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে, এবং মূসা ও ঈসাকে এবং অন্যান্য নবীদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে যা দেওয়া হয়েছে আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না এবং আমরা তার কাছে আত্মসমর্পণকারী ” (সূরা বাকারাহ্ ২ঃ ১৩৬ আয়াত)।
আসলেই কি আমরা উল্লেখিত আয়াতগুলি অনুসরণ করি ? আমরা কি সত্যি এর কোন বিভেদ করি না? যদিও আয়াত অনুযায়ী বলা সহজ যে, আমরা তাঁর কাছে আত্নসমর্পণকারী, অথচ বলি পূর্বের কিতাবসমূহ পরিবর্তন করা হয়েছে! কি আশ্চর্য আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি! কি এক হতাশাব্যজ্ঞক আমাদের বিবেচনাবোধ।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখুন, দেখবেন প্রথম শতাব্দীর শুরু থেকেই আহ্লে কিতাবের বিশ্বাসীরা ইহুদীদের হাতে নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে এবং যুগের এ পর্যন্ত তাদের অনেকে ক্লেশ ভোগ করে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন তবুও কিতাবের একটি অক্ষরও ত্যাগ করেন নাই। ঐতিহাসিকরা বলেন যে, তারা এমনকি আনন্দের সাথে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন আল্লাহর কালামের প্রতি বাধ্যতার কারণেই। তারা মসীহকে অস্বীকার করার চেয়ে গৌরবের মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন নিদ্বিধায়। অনেকে অত্যান্ত কষ্টকর মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন। কারণ তারা মসীহকে অবজ্ঞা করতে নারাজ ছিলেন কিংবা তাঁর সুসমাচারকে ত্যাগ করতে রাজি হন নাই।
তাদের জীবনকে নিয়ে লেখা বইগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বই যার নাম- By their blood: Christian Martyrs of Twentieth Century (Published by Matt Media) বইটির লেখক Dr. James Hefley and his wife Marti এছাড়াও Liberated Palestinian by Dr. Anis A. Shorossh বইটিতে ও অনেক তথ্য সংযোজন করা হয়েছে যা অত্যান্ত গুরুত্বতা বহন করে। Dr. Kenneth Latoureti এর বইটিও উল্লেখ্যযোগ্য।
কোনো মসীহ্ বিশ্বাসী বা অনুসারীকে কি কোনভাবে প্রভাবিত করা যাবে তার হাতের সেই বিশেষ কিতাবটি পরিবর্তনের জন্য? মোটেও না। কারণ, তাদের হাতের কিতাবেই উল্লেখ্য রয়েছে।
“যে সুসংবাদ আমরা তোমাদের তবলিগ করেছি তা থেকে আলাদা কোন সুসংবাদ যদি তোমাদের কাছে তবলিগ করা হয়, তা আমরা নিজেরাই করি বা কোন ফেরেশ্তাই করেন তবে তার উপর বদদোয়া পড়ুক”। (ইঞ্জিল শরীফ, গালাতীয় ১ঃ ৮ আয়াত)।
এছাড়া, তাদের হাতের কিতাবেই তো উল্লেখ্য রয়েছে-
“যে কেউ এই কিতাবের সঙ্গে কিছু যোগ করে তবে আল্লাহ্ ও এই কিতাবে লেখা সমস্ত গজব তার জীবনে যোগ করবেন। আর এই কিতাবের সমস্ত কথা, অর্থাৎ আল্লাহ্র কালাম থেকে যদি কেউ কিছু বাদ দেয় তবে আল্লাহ্ ও এই কিতাবে লেখা জীবন গাছ ও পবিত্র শহরের অধিকার তার জীবন থেকে বাদ দেবেন” (প্রকাশিত কালাম ২২ঃ ১৮-২২ আয়াত)।
কোরআন দৃড়তার সাথে সাক্ষ্য দেয় যে, তাওরাত, জবুর ও ইঞ্জিল অবধারিত সত্য এবং তা পরিবর্তনের সামর্থ্য কারো নেই। ইঞ্জিল শরীফের মথি সুসমাচারের ২৪ : ৩৫ আয়াতে ও বলা হয়েছে “আসমান ও জমীন শেষ হবে, কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকবে”।
ভল্টেয়ার (বিশিষ্ট ফরাসী নাস্তিক) এক সময় গর্ব করে বলেছিল যে, “কিতাবুল মোকাদ্দস” বা আহ্লে কিতাব দশ বছরের মধ্যেই মুছে যাবে মানুষের মন থেকে। আর বিশ বছরের মধ্যে মুছে যাবে পৃথিবী থেকে। উল্লেখ্য যে, এর কিছুকাল পরে ভল্টেয়ার মারা গিয়েছেন এবং তার নিজ বাসাটাই পরবর্ত্তীতে “কিতাবুল মোকাদ্দস” ছাপানোর কারখানাতে রূপান্তরিত হয়েছে।
উপসংহারে, একথা বলা যায় যে, মানুষ তার সু-বুদ্ধির প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাবে যদি সত্যিকার অন্বেষণ চালায় আল্লাহ্ কালামের গভীরতা উদ্ঘাটনের। আমার প্রার্থনা যেন তর্কের উর্দ্ধে উঠে খোলা মনে আল্লাহ্ মহান কালাম বোঝার চেষ্টা করি ও বিভ্রান্তিমুক্ত জীবন লাভ করি।
পরিশেষে ইঞ্জিল শরীফের কয়েকটি আয়াত দিয়ে প্রসঙ্গটির ইতি টানতে চাই, এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েই ইসলাম বিশেষজ্ঞরা দাবী করেন যে, তাওরাত ও ইঞ্জিলে নবীজির আগমনের কথা বলা হয়েছে। আসুন, খোলা মনে তা অনুধাবনের চেষ্টা করি।
ইঞ্জিল শরীফের ইউহোন্না পুস্তকের ১৫ অধ্যায় ২৬ আয়াতে বলা হয়েছে- “যে সাহায্যকারীকে আমি পিতার কাছ থেকে তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দেব, তিনি যখন আসবেন তখন তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্যি দিবেন। ইনি হলেন সত্যের রূহ্ যিনি পিতার কাছ থেকে আসবেন”।
আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে- “কিন্তু সেই সত্যের রূহ্ যখন আসবেন তখন তিনি তোমাদের পথ দেখিয়ে পূর্ণ সত্যে নিয়ে যাবেন। তিনি নিজ থেকে কথা বলবেন না, কিন্তু যা কিছু শোনেন তাই বলবেন, আর যা কিছু ঘটবে তাও তিনি তোমাদের জানাবেন” (ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৬ঃ ১৩ আয়াত)।
ইসলাম বিশেষজ্ঞরা দাবী করেন যে, এই দুটি আয়াতেই যার কথা বলা হয়েছে তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। আর তাই নির্দ্দিধায় তারা তখন ইঞ্জিল শরীফের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তখন বলা হয় না যে, তা অতিরজ্ঞিত হয়েছে বা বিকৃত করা হয়েছে। কিন্তু তারা হয়তো জানেনা যে, এহেন বক্তব্যই সত্যকে বিকৃত করে।
কারণ, প্রথমতঃ মুহাম্মদ (সাঃ) রূহ্ নন। তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ আমাদের মতো। দ্বিতীয়তঃ তিনি ঈসা মসীহ্ উদ্ধৃত পিতার কাছ থেকে আসেন নাই। তৃতীয়তঃ তিনি ঈসা মসীহের বিষয়ে স্পষ্ট সাক্ষ্য দেন নাই যেভাবে হযরত জাকারিয়া (আঃ) ও অন্যান্য ঈসাহীরা সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন বা আজো সাক্ষ্য বহন করে চলেছেন। সুতরাং, উল্লেখিত আয়াতসমূহে তাঁর বিষয়ে বলা হয় নাই। বলা হয়েছে পাক রূহের বিষয়ে যিনি খোদার আরশ থেকে এসেছেন, রক্ত-মাংসের শরীর নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন নাই।
পাক রূহ (অদৃশ্য) আজো ঈসাহী উম্মতদের অন্তরে বাস করেন ও চিরকাল থাকবেন। তিনি মানুষ বিশিষ্ট নন, তাই তাঁকে পেতে যুদ্ধ-বিদ্রহ করতে হয় না। পাপকে তিনি গ্রহণ করতে পারেন না। তাঁর বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হলে ইঞ্জিল শরীফের প্রেরিত পুস্তকের ২ অধ্যায়ের আয়াত সমূহ পড়ে দেখুন। ঈসা মসীহের বেহেশ্তে চলে যাওয়ার পর পরই সেই পাক রূহের আগমন ঘটেছিল স্ব-শব্দে জেরুজালেমেস্থিত ঈসাহী উম্মতদের মধ্যে। এরপর থেকে ঈসাহীরা পৃথীবির সর্বত্র বেরিয়ে পড়েন ঈসা মসীহের সু-সংবাদ এর বারতা নিয়ে। ইঞ্জিল শরীফের প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ে দেখা যায় পাক রূহের কর্মকান্ড ও ব্যাপ্তি।
পবিত্র কিতাবে উল্লেখ রয়েছে- “যে ইহুদীরা তাঁর উপর ঈমান এনেছিল, ঈসা তাদের বললেন, “আমার কথামত যদি আপনারা চলেন তবে সত্যিই আপনারা সত্যেকে জানতে পারবেন, আর সেই সত্যই আপনাদের মুক্ত করবে” (ইউহোন্না ৮ঃ ৩১, ৩২ আয়াত, ইঞ্জিল শরীফ)।
কোরআন শরীফে এ কথাও উল্লেখ্য রয়েছে- “আল্লাহ্ ঈসার অনুসারীদের কিয়ামত পর্যন্ত কাফেরদের উপর জয়ী করবেন। অতঃপর তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন (ঘটবে)। তারপর যে বিষয়ে আমাদের মত্যান্তর ঘটছে তার মীমাংসা করবেন” (সূরা আল ইমরান ৩ঃ ৫৫ আয়াত)।
إِذْ قَالَ ٱللَّهُ يَـٰعِيسَىٰٓ إِنِّى مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَىَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ وَجَاعِلُ ٱلَّذِينَ ٱتَّبَعُوكَ فَوْقَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ إِلَىٰ يَوْمِ ٱلْقِيَـٰمَةِ ۖ ثُمَّ إِلَىَّ مَرْجِعُكُمْ فَأَحْكُمُ بَيْنَكُمْ فِيمَا كُنتُمْ فِيهِ تَخْتَلِفُونَ (٥٥)
হযরত ঈসা আল-মাসীহ্ পৃথিবীতে শুধু বেড়াতে আসেন নাই। তিনি এসেছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট কর্ম সাধনের জন্য। তিনি মানুষ হয়ে মানুষের মাঝে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেন গোনাহ্গার মানব জাতিকে নাজাতের মধ্যদিয়ে আল্লাহর সাথে পূর্ণমিলনের পথ উন্মোচিত হয়। আর এ কাজের জন্যে তিনি স্বয়ং মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের গোনাহ্ সমস্ত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। এটাই তাঁর জগতে আগমনের অন্যতম কারণ।
যে মূল বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম তার প্রেক্ষিতে স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, আমাদের অজ্ঞতা ও প্রাচীন বদ্ধমূল ধারণার মারপ্যাঁচে আমরা হারিয়ে ফেলেছি সত্য উদ্ঘাটনের পথ। তাই অনভিপ্রেত আচরণ আর প্রানহীন উন্মাদনায় বারংবার অরণ্যে রোদন করে অভিযোগ তুলি যে, “কিতাবুল মোকাদ্দস (তাওরাত, জবুর, ইঞ্জিলের সমষ্টি) পরিবর্তন করা হয়েছে। আসুন না অন্যের কথায় কর্ণপাত না করে নিজেই একটু সততার বিশ্লষণে বিবেচনা করে দেখি মূল বিষয়টি। মহান আল্লাহ্ পাকের বাণী হোক আপনার পথের আলো।
প্রসঙ্গতঃ আরও একটি আয়াত আমাদের জানা দরকার। আর তা হলো- “যখন ফেরেশতাগণ বলল,‘হে মরিয়ম! আল্লাহ্ নিজের পক্ষ থেকে তোমাকে তাঁর এক বানীর সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হলো মসীহ্-মারইয়াম-তনয় ঈসা, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাস্মানের অধিকারী এবং আল্লাহ্ ঘনিষ্ঠদের অন্যতম”। (আল-ইমরান ,৩ঃ ৪৫ আয়াত)।
এছাড়াও, আরো একটি আয়াত প্রনিধান যোগ্য। এতে বলা হয়েছে “তোমরা বলঃ আমরা বিশ্বাস করেছি আল্লাহকে এবং যা নাযিল হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তার বংশধরদের প্রতি এবং যা দেয়া হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা দেয়া হয়েছে অন্যান্য নবীদের তাদের পালনকর্তার কাছ থেকে। আমরা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য করি না। আর আমরা তাঁরই কাছে আত্মসমর্পনকারী”। (সূরা বাকারাহ, ২ঃ ১৩৬ আয়াত।)
সত্য বাক্য উচ্চারণের সক্ষম কোন ব্যক্তি কি জোর গলায় বলতে পারেন “আমিন” শব্দটি এই আয়াতটির সাথে সঙ্গতি রেখে? আসলে কি বলা সম্ভব যে আমরা পার্থক্য করি না যা দেওয়া হয়েছে আমাদের পালনকর্তার কাছ থেকে? কিংবা আমরা তাঁর কাছে আত্মসমর্পনকারী? যদি তা বলতে পারি তাহলে কি বলবো যে, ইব্রাহীমের কিতাব তাওরাত পরিবর্তন করা হয়েছে?
আল্লাহ্ রাব্বুলআলামিন বলেন- “আর আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে পর্যায়ক্রমে রসূলকে প্রেরণ করেছি, মারিয়ামের পুত্র ঈসাকে আমি স্পষ্ট মু’জিয়া দান করেছি এবং পবিত্র রূহের মাধ্যমে তাকে শক্তিশালী করেছি”। (সূরা বাক্বারাহ, ২ঃ ৮৭)
মূসাকে যে কিতাবটি আল্লাহ্ দিয়েছেন তা হলো “তাওরাত।” আর দায়ূদ নবীকে দেওয়া হয়েছে জবুর শরীফ। এর পরে নবীদের জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে নবীদের কিতাবে যা স্পষ্টতঃ কিতাবুল মোকাদ্দসে সংযুক্ত রয়েছে। পরবর্ত্তীতে হযরত ঈসা আল মসীহ্ এর প্রকাশ ঘটে যা ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত রয়েছে। অথচ আমাদের বিভ্রান্তিকর বিবেচনায় আমরা বলি তা বাতিল করা হয়েছে। আর এ বাতিল করার সংবাদ আল্লাহ্ জানলেন না?
একেই বলে নিয়তি! আল্লাহ্ চেয়ে বান্দার জ্ঞান যখন বৃদ্ধি পায় তখন বুঝতে হবে শয়তানের কারসাজি হলো মানুষকে ধোঁকা দেওয়া। সে তো আর গলা ধাক্কা দিতে পারে না তাই ধোঁকা দিয়েই পথভ্রষ্ট হতে শেখায়, আর যারা তার পাল্লায় পড়ে অন্ধকারে বেহেশ্তের দরজা খুঁজে বেড়ান, তাদের কপালে দুঃখ জটিলতা ছাড়া কিছুই থাকে না অবশিষ্ট।
আল্লাহ্ তায়ালা যাদের জন্য পরকালের পুরস্কার নিশ্চিত ঘোষনা দিয়েছেন তাদের মধ্যে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের নাম নেই। আছে যিহুদী খ্রীষ্টানদের নাম, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে চলুন সূরা বাকারার অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ে। দেখুন কি বলা হয়েছে এখানে- “নিঃসন্দেহে যারা বিশ্বাস করে এবং যারা ইহুদী আর খ্রীষ্টান ও সাবিঈন- তাদের মধ্যে থেকে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছেন, তাদের জন্যে রয়েছে পুরষ্কার তাদের প্রতিপালকের কাছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেন না”। (সূরা ২ঃ ৬২)
ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখার মতো, আমরা যারা ইসলাম ইসলাম করে সর্বদা গলা ফাটাই আর কপাল ঠুকি শক্ত মেঝেতে, তাদের কথা এ আয়াতে বলা হলো না কেন? ইহুদী, খ্রীষ্টান ও সাবিঙ্গনরা নির্দ্দিধায় আল্লাহর পুরষ্কার পাবে আর আমরা দূর থেকে আমিন, আমিন করে যাবো? দুঃখিত হবার বিষয়টি কি আমাদের জন্য একক প্রাপ্য?
তারপরেও যদি কেউ শুনতো আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এর কথা! চারিদিকে মাইক ফাটানো ওয়াজ মাহফিলে জড়ো হয়ে কি শুনি আমরা? বিধর্মীদের গালাগালি, নির্লজ্জ চিৎকার আর বাহারী গজলের সূর। কখনো বা মারো-ধরো, তাদের জখম করো যারা ইসলামের ধার ধারে না কখনো। কেনো কেউ কোনদিন ব্যাখ্যা করেনি কোরআনের এইসব আয়াতসমূহ তা বিস্ময়কর। এগুলো কি বাতিল হয়ে গেছে তাদের কালিমা দগ্ধ অন্তরের বাসনা থেকে? নাকি তাদের অপ্রশস্ত বিবেচনায় কখনো কি সাড়া জাগায়নি এইসব আয়াতের মাধুর্য?
বস্তুতঃ অশিক্ষার যন্ত্রনাকাতর কুশিক্ষার মোক্ষম তাড়নায় তারা (ওয়াজীরা) আজ দিশেহারা। তাদের গলা ফাটানো চিৎকারে নতুন এ প্রজন্মের প্রজ্ঞাবান তরুণেরা তাই আমোদ খুঁজে পেয়েছে। ওয়াজ-নসিহত আজ বিনোদনের খোরাক যোগাচ্ছে ঘরে ঘরে। “বইসা পড়েন, বইসা যান, ঢাইলা দেই, একটু খান,”যেন আজ কৌতুক আর বিনোদনের নমুনা হয়েছে তাহেরী, হাজারীদের বদৈালতে। আল্লাহ্ নামে তারা যেন ইসলামের ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছেন মাঠে-ময়দানে। ইসলামের বন্দেগী করবে মানুষ নাকি মহান আল্লাহ্ তায়ালার? এসব কিছুই প্রকাশ করে যে তারা আল্লাহ্ থেকে বিচ্ছিন্ন। সর্বশেষে আবারও বলি এবার সময় এসেছে বুঝে শুনে কথা বলার। মনে রাখতে হবে যে মহান আল্লাহর দৃষ্টি রয়েছে জগতের সর্বত্র। সূরা বাকারার এই আয়াতটি এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়-
বাংলা অর্থ: “আর এটা এ কারণে যে, আল্লাহ্ সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছেন। আর যারা কিতাব সম্পর্কে মতবাদ সৃষ্টি করেছে নিশ্চয় তারা (সত্য থেকে) অনেক দূরে মতপার্থক্যের মধ্যে নিপাতিত রয়েছে”। (সূরা বাকারাহ, ২ঃ ১৭৬)
আরেকটি চোখ ধাঁধানো আয়াত রয়েছে কোরআনে, তাতে বলা হয়েছে-“আমি এসেছি তাওরাতে যা বলা আছে, তার সমর্থকরূপে ও তোমাদের জন্য যা নিষিদ্ধ ছিল তার কতকগুলিকে বৈধ করতে, এবং আমি রবের নিকট থেকে নিদর্শন এনেছি। কাজেই, আল্লাহ্কে ভয় কর আর আমাকে মান” (আল-ইমরান, ৩ঃ ৫০ আয়াত)। উক্তিটি হযরত ঈসা আল্ মসীহের। তাঁর কথা অনুযায়ী “আল্লাহ্কে ভয় কর আর আমাকে মান” কথাটি অত্যান্ত প্রণিধানযোগ্য যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
আল্লাহ্কে ভয় করার কথা না হয় নাই বললাম, এটি প্রতিটি ব্যক্তির বিবেচনার বিষয়। তাঁকে ভয় করলে তো আর অনৈতিক ও অরাজকতা চোখে পড়তো না এদেশে। কিন্তু ঈসাকে যে আমরা মানি না তা অতি সুস্পষ্ট। তাঁকে মানলে তো আর কোন বুজুরর্গ, আলেমদের দরবারে উপস্থিত হতে হতো না কাউকে। তাঁর কথা না শুনে আমরা বরং আল্লাহু আল্লাহু জিকিরে মনোনিবেশ করছি বেশী। সেই সাথে আত্মতৃপ্তির তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে মক্কা-মদিনার দিকে ধাবিত হচ্ছি প্রায়শঃ। “আল্লাহকে ভয় কর” কথাটি অন্তরে নোঙর না ফেললেও আমাদের চিত্ত-চৈতন্যের পাশ ঘেঁষে চলে যায় অনন্ত অন্ধকারের এক অজানা অরণ্যে। “আর আমাকে মান” কথাটি অবধান করার মতো সৎ সাহস বা বিশ্বাস কারো মাঝে মাথা চিড়ে ওঠেনি আজো। ঈসাকে মানা মানেই তাঁকে অনুসরণ করা, দু’চারটি সেজ্দা দেওয়া নয় শুধু। এখানে এসেই থম্কে যায় আমাদের বিশ্বাসের চালিকা শক্তি। সেইসাথে স্মিমিত হয় সত্য জানার উদ্যম।
উপসংহারে, যে বাক্যটির অবতারণা করবো সেটাই বা এড়িয়ে যাবেন কিভাবে? এখানে উল্লেখ রয়েছে- “আল্লাহ্ ঈসার অনুসারীদের কিয়ামত পর্যন্ত কাফেরদের উপর জয়ী করবেন। অতঃপর তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন (ঘটবে)। তারপর যে বিষয়ে আমাদের মত্যান্তর ঘটবে তার মীমাংসা করবেন”। (সূরা আল-ইমরান, ৩ঃ ৬৫ আয়াত)।
আসুন, তাঁর কাছে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর কালাম বুঝতে চেষ্টা করি আর উপলদ্ধি করি সত্য জানার আনন্দ। আল্লাহের রহমত আর ঈসা মসীহের দয়ায় আমরা যেন খুঁজে পাই সত্যেও আলোকিত পথ। আর সে পথে চলে মুক্ত হই সমস্ত বিভ্রান্তির জটিলতা থেকে, এই আমার প্রার্থনা।
আরও জানুন: আল্লাহর বিভাজন: আল্লাহ্ কয়ভাগে বিভক্ত? (১ম অংশ) |
Pingback: আয়েশা (রাঃ) ও সাফওয়ান (রাঃ) বিষয়ক অপবাদ | all about Him
Pingback: কে আমাদের নাজাতদাতা? রসুলুল্লাহ্ না রুহুল্লা | all about Him